
রোজাদার মুত্তাকীগনকে বা নাফস মুৎমায়িন্নাকে আখেরাতে বলা হবে“হে মুৎমায়িন্না নফস, তুমি সন্তুষ্ট হয়ে এবং আল্লাহ তা‘আলার সন্তোষ লাভ করে আমার বান্দাদের শামিল হয়ে আমার জান্নাতে দাখিল হও।” কাজেই দেখা যায়, এই নফস মুৎমায়িন্না হাসিল করাই হচ্ছে মানুষের পক্ষে চরম রূহানী তরক্কী। যে ব্যক্তি আল্লাহ তা‘আলার ও তাঁর রাসূলের বিধিনিষেধ পরিষ্কারভাবে জানতে পারার সঙ্গে সঙ্গে ঐ বিধি-নিষেধ কোন প্রকার দ্বিরুক্তি বা আপত্তি না করে তাই যথার্থ বলে মেনে নেয় এবং নির্বিকার-চিত্তে, অম্লান বদনে তা পালন করে চলে তার নফসকে মুৎমায়িন্না বলা সঙ্গত হবে। কারণ সে আল্লাহর আদেশ পালন করে সন্তুষ্টও থাকে এবং সে আল্লাহর সন্তোষ লাভেও সক্ষম হয় আর একেই বলা হবে চরম রূহানী তরক্কী হয়েছে।এখন দেখা যাক, এই রূহানী তরক্কী লাভের ব্যাপারে রামাযানের কতখানি দান রয়েছে।এ সম্বন্ধে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “রমযান মাস- এমন একটি মাস যে মাসে নাযিল করা হয়েছে আল-কুরআন। এই আল-কুরআন লোকদের ঠিক পথে চালায়, ঠিক পথের স্পষ্ট আলামত দেখায় এবং ন্যায়কে অন্যায় থেকে পৃথক করে দেয়। এখানে আল্লাহ তা‘আলা বলেন যে, তিনি তাঁর বান্দাদের প্রতি রামাযান মাসে যে সওগাত পাঠান তা হচ্ছে আল-কুরআন। আল্লাহ তা‘আলা আদম সন্তানকে যত নে‘মত দান করেছেন তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ নে‘মত হচ্ছে আল-কুরআন। কারণ আল্লাহর আর সব নে‘মাত মূলতঃ নশ্বর দেহের পুষ্টি সাধন করে অথবা নশ্বর দেহকে আরাম আয়েশ দান করে থাকে; কিন্তু আল-কুরআন নশ্বর দেহ পালনের যাবতীয় ব্যবস্থা দান করার সঙ্গে সঙ্গে অবিনশ্বর, চিরস্থায়ী রূহের সকল প্রকার কল্যাণের পথ উন্মুক্ত করে। কাজেই মানুষ যে মাসে এই অমূল্য সওগাত আল-কুরআন লাভ করেছে, মানুষের ইতিহাসে সেই মাসটি যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মহান তাতে কোনই সন্দেহ থাকতে পারে না। তারপর এই রামাযান মাসে শুধু যে আল-কুরআনই নাযিল হয়েছিল তা নয়, বরং আল্লাহ তা‘আলা এইমাসে আরও অনেক গ্রন্থ নাযিল করেছেন। তফসীরকারকগণ বলেন, নবী (সা) বলেছেন, “এই রামাযান মাসের প্রথম অথবা তৃতীয় তারিখে ইবরাহীমের (আ) প্রতি সহীফাগুলি নাযিল হয়েছিল। আবার রামাযান মাসের ৭ তারিখে মূসার (আ) প্রতি তওরাৎ, ১৩ তারিখে ‘ঈসার (আ) প্রতি ইন্জীল ও ১৮ তারিখে দাউদের প্রতি যবূর হয়। কাজেই দেখা যায়, আল্লাহ তা‘আলা মানুষকে এই রামাযান মাসে গ্রন্থাদি দান করে যে দয়া প্রকাশ করেছেন তা স্মরণ করেও তার শুকরীয়া স্বরূপ মানুষ এই মাসকে গানীমত-জ্ঞানে এই মাসে যথাসাধ্য নেক আমল সম্পাদন করে রূহানী তরক্কী লাভের জন্য প্রাণপন কোশেশ করতে থাকবে। তারপর এই মাসে রূহানী তরক্কী লাভ করবার জন্য মুসলিম কী ভাবে কোশেশ করতে থাকবে তাও আল্লাহ তা‘আলা দয়া করে তাঁর বান্দাদের জানিয়ে দিয়েছেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, “যে কেউ রামাযান মাসের হিলাল চাঁদ দেখবে তার কর্তব্য হবে এই মাস ভরে রোযা রাখা।” নবী মুহাম্মাদ সালালাহু আলাইহি ওয়া সালামের হিজরতের দ্বিতীয় সালে মুসলমানদের উপর এক মাস সিয়াম ফরয করা হয়। ধন ও মালের যেমন যাকাত আদায় করতে হয় ঠিক তেমনি সিয়াম শরীরের যাকাত স্বরূপ। ইবনে মাজাহ ও মেশকাত শরীফে বর্ণিত আছে যে, প্রত্যেক বস্তুর যাকাত (পরিশোধক) রয়েছে, আর দেহের যাকাত হল ‘সিয়াম’। সিয়াম দ্বারা মানুষ শারীরিক, মানসিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করবে এটাই ইসলামের শিক্ষা। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মায়া, মাৎসর্য এই ষড় রিপুকে নিয়ন্ত্রিত করাই সিয়ামের বিশেষ উদ্দেশ্য। এই ষড় রিপুই মানুষের উন্নতির প্রধান অন্তরায়। ষড় রিপু দমন করা ইসলামের শিক্ষা নয় বরং এ গুলোকে নিয়ন্ত্রিত করাই ইসলামের শিক্ষা। এই রিপু দমনের জন্যে খৃষ্টান, বৌদ্ধ ও হিন্দুদের মধ্যে বিবাহ না করে বা সংসার ত্যাগ করে বনে জঙ্গলে বাস করবার মত কষ্টসাধ্য রীতি চালু আছে। ইসলাম ষড় রিপুকে বস্তুত শরীরের দাবী বলে স্বীকার করে কিন্তু এর দমন নয় বরং শরীয়তের সীমার মধ্যে এর নিয়ন্ত্রণ করাই কর্তব্য বলে মনে করে। এগুলোর ন্যায় সংগত চাহিদা পূরণের দ্বারা মানব জীবন সুন্দর, মার্জিত ও উৎকর্ষ মন্ডিত হয়। এগুলোর চরম স্বল্পতা জীবন কে স্থবির, পঙ্গু ও অথর্ব করে দেয়। আবার এ সবের ব্যাপারে অত্যাধিক বাড়াবাড়ি জীবনকে লাগামহীন ও বেপরোয়া করে তুলে এবং পশুত্বের দিকে ঠেলে দেয়। ইসলাম চারটি মৌলিক চাহিদার বিজ্ঞান সম্মত ও ন্যায় সঙ্গত বাস্তবায়নের দ্বারা মানব চরিত্রকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে আগ্রহী এবং এ কাজে সিয়ামের ভূমিকা সর্বাধিক।পবিত্র রমজানের আসল উদ্দেশ্য হলো তাকওয়া বা খোদাভীরু লোক তৈরী করা । এবং এটাই আল্লাহর একমাত্র লক্ষ্য। আল্লাহ রব্বুল আলামিন কুরআনে রমজানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে এরশাদ করেন, ইয়া আয়্যুহালালিনা আমানু কুতিবা আলাইকুমুস সিয়ামু কামা কুতিবা আলালাজিনা মিন কবলিকুম লায়্লাাকুম তাত্তাকুন। অর্থাৎ ‘হে ঈমানদার বান্দারা ! তোমাদের উপর রমজানের রোজা ফরজ করা হয়েছে,যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের উপর ,যেন তোমরা তাকওয়া বা খোদাভিরুতা অর্জন করতে পার। তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, আল্লাহ তায়ালার দেয়া রোজার আসল উদ্দেশ্যই হচ্ছে খোদাভিরুতা বা তাকওয়া অর্জনের এক মিশন। আর তাকওয়া হলো আল্লাহর ভয় এবং ভালোবাসার অনূভুতি। আল্লাহ তাযালার প্রতি ঈমান আর তার সিমাহীন অনুগ্রহের অনুভূতি থেকে তার প্রতি আমাদের ভালবাসা তৈরি হয়। আর তাঁর অনান্য গুনাবলী রাগ-ক্ষোভ শাস্তি দানের ক্ষমতার ধারণা বিশ্বাস থেকে আল্লাহর প্রতি ভয়ের সৃষ্টি হয়। আর এ ভালবাসা আর ভয়ের মানসিক অবস্থার নাম তাকওয়া। আর তাকওয়া সকল ভাল কাজের উৎস এবং মন্দ কাজ থেকে বেচে থাকার উপায়। এ জন্যই পবিত্র কুরআনের একেবারে প্রথম দিকে সুরা বাকারায় এরশাদ হচ্ছে , এ কিতাব অর্থাৎ কুরআন থেকে তাকওয়া অর্জনকারী মুত্তাকিগনই হেদায়েত লাভ করেতে পারবে। রোজাদার বা মুত্তাকীগন আল্লাহর মহিমা রোজা রেখে দুনিয়ায় যেমন পেতে থাকবে তেমনিভাবে আল্লাহর পক্ষ থেকে চির কল্যানের জান্নাতি মহিমাও মুত্তাকীগন আখেরাতে পাবেন । আল্লাহর রাসুলের একটি হাদিস তুলে ধরছি, হযরত সাহল ইবনে সায়াদ (রা:) হতে বর্নিত আছে ,তিনি বলেন, রাসুলুলাহ (স:)এরশাদ করেন,বেহেস্তের আটটি দরজা আছে। তার মধ্যে একটি দরজার নাম হলো রাইয়্যান। আর উক্ত দরজা দিয়ে শুধু রোজাদাররাই প্রবেশ করতে পারবে। (বুখারী-মুসলীম)