
চলতি বিশ্বকাপের ৩১তম ম্যাচে বাঘের থাবায় কুপোকাত নবী-রশিদরা। সহ-অধিনায়ক সাকিব আল হাসানের অসাধারণ নৈপুণ্যে আফগানিস্তানের বিপক্ষে বাংলাদেশ জয় পেয়েছে ৬২ রানের ব্যবধানে। ব্যাটে-বলে ম্যাচের অবিসংবাদিত নায়ক সাকিব আল হাসানই। যিনি বিশ্বকাপের ইতিহাসে মাত্র দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে একই ম্যাচে ৫০ রান ও ৫ উইকেট নেয়ার রেকর্ড গড়েছেন।
বাংলাদেশের দেয়া ২৬৩ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে ৩ ওভার বাকি থাকতেই সব উইকেট হারিয়ে স্কোরবোর্ডে ২০০ রান তুলতে সক্ষম হয় আফগানিস্তান। আর এ জয়ে সেমিতে খেলার আশা বাঁচিয়ে রাখল মাশরাফিরা।
এর আগে সোমবার (২৪ জুন) সাউথাম্পটনের রোজ বোলে টস জিতে বাংলাদেশকে ব্যাটিংয়ে আমন্ত্রণ জানান আফগান অধিনায়ক গুলবাদীন নাঈব। ম্যাচটি শুরু হয় বাংলাদেশ সময় বিকেল ৩টা ৪০ মিনিটে। সরাসরি সম্প্রচার করে বিটিভি, গাজী টিভি ও মাছরাঙা চ্যানেল।
ম্যাচের শুরুতেই গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচটায় হানা দেয় বৃষ্টি। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির কারণে নির্ধারিত সময়ে টস করা যায়নি। ১০ মিনিট দেরি করে হয়েছে টস।
টস হেরে ব্যাটিংয়ে নেমে শুরুতেই উইকেট হারায় বাংলাদেশ। ইনিংসের পঞ্চম ওভারে মুজিব উর রহমানের বলে শর্ট কাভারে ক্যাচ দিয়ে ফিরেন লিটন দাস। অথচ লিটনের শুরুটা হয়েছিল দুর্দান্ত। মূলত ওপেনিং জুটিতে তিনিই ভালো খেলছিলেন। ১৭ বলে ২ বাউন্ডারিতে ডানহাতি এই ব্যাটসম্যান করেন ১৬ রান।
শুরুতেই লিটন দাসকে হারানোর পরে দেখেশুনে খেলছিলেন দুই বন্ধু সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবাল। তবে ব্যক্তিগত ৩৬ রানে বলে মোহাম্মাদ নবীর বলে বোল্ড আউট হয়ে ফিরে যান তামিম।
পরের ওভারে রশিদ খানের প্রথম বল সাকিবের প্যাডে লাগলে আম্পায়ার আউট দেন। তবে রিভিউ নেন বাঁহাতি ব্যাটসম্যান। রিভিউয়ে বল স্টাম্প মিস করায় আউটের সিদ্ধান্ত বাতিল হয়। ২৬ রানে জীবন পান সাকিব।
তৃতীয় উইকেটে ৬১ রানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ জুটি গড়েন সাকিব-মুশফিক। সাকিব একবার রিভিউ নিয়ে বেঁচে গেলেও ৩০তম ওভারে এসে বাঁচতে পারেননি। মুজিব উর রহমানের বলে এলবিডব্লিউ হয়ে ফিরেছেন তিনি। ৬৯ বলে গড়া সাকিবের ৫১ রানের ধৈর্যশীল ইনিংসটিতে ছিল মাত্র একটি বাউন্ডারির মার।
মুজিবের পরের ওভারে আবারও ঝলক। এবার তিনি ফিরিয়ে দেন ওপেনিং থেকে মিডল অর্ডারে আসা সৌম্য সরকারকে। এলবিডব্লিউ হওয়ার আগে সৌম্য করেন মাত্র ৩ রান। ১৫১ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে তখন ফের বিপদে বাংলাদেশ।
এরই মধ্যে পায়ের কাফে টান পড়ে নতুন ব্যাটসম্যান মাহমুদউল্লাহর। তিনি তখন মাত্র ৩ রানে। টাইগার সমর্থকরা ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়ে গিয়েছিলেন। তবে মাহমুদউল্লাহ ওই ব্যথা নিয়েই ব্যাটিং চালিয়ে গেছেন।
পঞ্চম উইকেটে মুশফিক আর মাহমুদউল্লাহ যোগ করেন ৫৬ রান। ৩৮ বলে ২ বাউন্ডারিতে ২৭ রান করে মাহমুদউল্লাহ গুলবাদিন নাইবের শিকার হন।
এমন উত্থান পতনের মধ্যে একটা প্রান্ত ধরে দলকে টেনে নিয়ে গেছেন মুশফিক। ষষ্ঠ উইকেটে মোসাদ্দেক হোসেনকে নিয়ে ৩৩ বলে ৪৪ রানের জুটি তার। সেঞ্চুরির সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু ইনিংসের ৪৯তম ওভারে এসে দৌলত জাদরানের বলে মারতে গিয়ে ক্যাচ হয়ে যান মুশফিক। ৮৭ বলে ৪ বাউন্ডারি আর ১ ছক্কায় তখন তিনি ৮৩ রানে।
এরপর মোসাদ্দেক শেষের কাজটা করে দিয়েছেন। ২৪ বলে ৪ বাউন্ডারিতে ৩৫ রানের ঝড়ো ইনিংস খেলে একদম শেষ বলে আউট হয়েছেন ডান হাতি এই ব্যাটসম্যান। ফলে নির্ধারিত ৫০ ওভার শেষে টাইগারদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৭ উইকেটে ২৬২ রান।
আফগানিস্তানের পক্ষে মুজিব উর রহমান ৩টি আর গুলবাদিন নাইব নিয়েছেন ২টি উইকেট।
২৬৩ রানের টার্গেটে খেলতে নেমে ভালো ব্যাট করছিল আফগানিস্তান। দলীয় ১১তম ওভারে ছন্দপতন হয়। যেখানে নিজের প্রথম ওভারের পঞ্চম বলে রহমত শাহকে তামিম ইকবালের ক্যাচে ফেরান সাকিব আল হাসান। ৩৫ বলে তিনটি চারে ২৪ রান করেন রহমত।
দ্বিতীয় উইকেট জুটিতে ৩০ রান করে বাংলাদেশ বোলারদের হতাশা বাড়াচ্ছিলেন গুলবাদিন নাঈব ও হাশমতউল্লাহ শহিদী। কিন্তু ২১তম ওভারের পঞ্চম বলে ও দলীয় ৭৯ রানে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতের শিকার হয়ে মাঠ ছাড়েন শহিদী। মুশফিকুর রহিমের দুর্দন্ত স্টাম্পিংয়ে আউট হওয়ার আগে ৩১ বলে কোনো বাউন্ডারি ছাড়া ১১ রান করেন তিনি।
নিজের পঞ্চম ও দলীয় ২৯তম ওভারে এসে জোড়া উইকেট তুলে নিলেন সাকিব আল হাসান। প্রথম বলে গুলবাদিন নাঈবকে ও তৃতীয় বলে নতুন ব্যাটসম্যান মোহাম্মদ নবীকে (০) সরাসরি বোল্ড করেন সাকিব। নাঈব ৭৫ বলে তিনটি চারে ৪৭ করেছেন। এরই সঙ্গে প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে বিশ্বকাপে এক হাজার রান ও ৩০ উইকেট নেওয়ার বিশ্বরেকর্ড গড়লেন সাকিব। এর ম্যাচেই সাকিব ফিফটি করার পর এক হাজার রান পূর্ণ করেন। আর ২৮ উইকেট নিয়ে খেলতে নেমেছিলেন।
পরে আসগর আফগানকেও ব্যক্তিগত ২০ রানে বিদায় করে নিজের চতুর্থ উইকেট তুলে নেন এই তারকা। আফগানিস্তান ১৩ রানের ব্যবধানে সাকিবের কাছে হারায় তিন ব্যাটসম্যানকে। এরপর লিটনের দুর্দান্ত থ্রোতে ষষ্ঠ উইকেটের পতন ঘটে। ৩৬তম ওভারের প্রথম বলে রান আউট হন ইকরাম আলী খিল (১১)।
ওই ওভারে সামিউল্লাহ শিনওয়ারির বিরুদ্ধে মেহেদী হাসান মিরাজের এলবিডাব্লিউর আবেদনে আম্পায়ার সাড়া দেননি। এই সুযোগে রান নিতে চেষ্টা করেন ইকরাম। কিন্তু সামনে এগিয়ে গিয়ে নন স্ট্রাইকিং প্রান্তে ফিরে আসতে হয় তাকে। সীমানায় ঢোকার আগেই লিটন সরাসরি তার স্টাম্প ভাঙেন।
নাজিবউল্লাহ জাদরানকে ফিরিয়ে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপে ৫ উইকেট পূর্ণ করেন সাকিব আল হাসান। একই আসরে সেঞ্চুরি ও ৫ উইকেট নেওয়া এলিট ক্লাবে যোগ দেন তিনি, যেখানে আছেন যুবরাজ সিং ও কপিল দেবের মতো খেলোয়াড়রা। ২৩ বলে দুটি চারে ২৩ রান করে স্টাম্পিং হন নাজিব।
পরের ওভারে রশিদ খানকে (২) মাশরাফির ক্যাচ বানান মোস্তাফিজ। পরের ওভারে এই বাঁহাতি পেসার দৌলত জাদরানকে রানের খাতা না খুলতে দিয়ে মুশফিকের ক্যাচ বানান। মুজিব উর রহমানকে বোল্ড করে জয় নিশ্চিত করেন মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন। ৫১ বলে ৩ চার ও ১ ছয়ে ৪৯ রানে অপরাজিত ছিলেন শিনওয়ারি।
১০ ওভারে ২৯ রান দিয়ে ৫ উইকেট নেন সাকিব। এটাই তার ক্যারিয়ার সেরা বোলিং। দু’টি উইকেট নেন মোস্তাফিজ, একটি করে পান সাইফ ও মোসাদ্দেক। এ ম্যাচেও সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন সাকিব। এনিয়ে তিনটি জয়েই বাঁহাতি অলরাউন্ডার হয়েছেন ম্যাচসেরা।