শিরোনাম |
❒ তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রধান কারণ জলাধার কমে যাওয়া
❒ দেড় ডজন বিশাল পুকুরের উপর বহতল ভবন
যশোরে পরিবেশ ও প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন উপেক্ষা করে গত একযুগে ভরাট করে ফেলা হয়েছে ১৪ হাজার পুকুর। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর কার্যকরী উদ্যোগ না থাকায় বিগত বছরগুলো পুকুর ও জলাশয় ভরাটের মহোৎসব চলেছে। শুধুমাত্র শহর ও শহরতলীতে ভরাট হয়ে গেছে একশ’র বেশি পুকুর। আর যশোর পৌরসভার মধ্যে একডজন পুকুরের উপর শোভা পাচ্ছে অনেক বহুতল ভবন। এছাড়া যশোরে ভৈরব নদ পূণ খননের সময় দু’পাড় এলাকার বসতিরা ঠিকাদারকে ম্যানেজ করে শতাধিক পুকুর ভরাট করিয়ে নিয়েছেন।
অব্যাহত পুকুর ও জলাশয় ভরাট হওয়ার কারণে দূর্বিসহভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পরিবেশের উপর পড়ছে প্রতিকুল প্রভাব। নেমে যাচ্ছে পানির স্তরও।
পরিসংখ্যান ব্যুরো থেকে তথ্য মিলেছে, এক যুগের ব্যবধানে যশোরে ভরাট হয়ে গেছে ১৪ হাজার পুকুর। ২০১১ সালের জরিপ অনুযায়ী জেলাটিতে পুকুর ছিল ৫৩ হাজার ৯৪২টি। বর্তমানে জাতীয় তথ্য বাতায়নের তথ্য অনুযায়ী যশোরে পুকুরের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ১২৯টি।
এছাড়া যশোর পৌরসভার তথ্যানুযায়ী, পৌরসভা এলাকায় পৌরসভার নামীয়, জেলা প্রশাসকের নামীয় ও বেসরকারি মিলে ৩শ২০টি জলাশয় রয়েছে। এর মধ্যে পৌরসভার ৬টি, জেলা প্রশাসকের ৪০টি এবং বেসরকারি ২৭৪টি পুকুর রয়েছে। ১০/১২ বছর আগে পুকুরের সংখ্যা আরো বেশি ছিল।
খোঁজ নিয়ে তথ্য মিলেছে, যশোর পৌরসভা এলাকায় শহরের ঐতিহ্যবাহী প্রায় সব পুকুর তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। বিগত এক থেকে দেড়যুগে ভরাট হয়ে গেছে যশোর হেডপোস্ট অফিসের সামনের পুকুর, যশোর রেলগেট চোরমারা দীঘি, নিরালা সিনেমা হলের পাশের পুকুর, বেজপাড়ার শ্রীধর পুকুর, আরবপুরের বড় পুকুর, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন সড়কের ইসমাইল ডাক্তারের বাড়ির পেছনের বড় দীঘি, ইসলামী স্কুলের পুকুর, পুরাতনকসবা আবু তালেব সড়কের পুকুর, ডাক্তার মোজাম্মেল হোসেনের পুকুর, মন্টুদের পুকুর, নিরিবিলি পুকুর, রাজুদের পুকুর, মুন্সীবাড়ি পুকুর, আয়নাল খাঁর পুকুর, জব্বার বিহারীর পুকুর, গোহাটা পুকুর, রাজবাড়ী বিদ্যুৎ অফিসের সামনের পুকুর, ষষ্ঠিতলাপাড়ায় ফায়ার সার্ভিস অফিসের সামনের পুকুর, খালধার সড়কের পুকুরসহ শহরের ভেতরে থাকা আরো কিছু পুকুর এখন সমতল ভূমি। প্লট আকারে বিক্রিও হচ্ছে।
এদিকে গত ৪ বছরে ভৈরব খননকে পুঁজি করে ঠিকাদার নিযুক্ত লোকজন ও কয়েকটি দালাল চক্রের লোকজনের মধ্যস্থতায় নদ পাড় এলাকায় শতাধিক পুকুর ভরাট করা হয়েছে। পরিবেশে আইন লংঘন করে বিভিন্ন এলাকার পুকুর শুন্য করা হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারের বাধা উপেক্ষা করে ভৈরব নদে চলা ড্রেজার মেশিন দিয়ে দীর্ঘ পাইপ লাগিয়ে বালি কাঁদা মাটি তুলে পুকুরগুলো ভরাট করা হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন উপেক্ষা করে যশোর শহর ও শহরতলীর বিভিন্ন এলাকায় ভৈরব নদের অদুরে থাকা পুকুরগুলো একেএকে ভরাট হয়েছে। সুবিধাবাদী পুকুর মালিকগন বিকল্প মুনাফার আশায় ওই সময় ভৈরব নদ খননে ব্যবহার হওয়া ড্রেজার মেশিন ব্যবহার করেছেন। সরেজমিনে ঘুরে শতাধিক পুকুর ভরাট হওয়ার প্রমাণ মিলেছে। এক সময়ের দীঘি বড় পুকুর যেখানে মাছ চাষ হত পাড়ামহল্লার শ’শ’ মানুষ নানাভাবে উপকার পেতেন। আজ তাদের বঞ্চিত করে পুকুর ভরাট করে সমতল ভূমি করা হচ্ছে।
যশোর ঘোপ বউ বাজার এলাকার বাসিন্দা খাদিজা আক্তার নিপা জানিয়েছেন, এর আগে গোসল, কাপড় ও থালাবাসন ধোয়া, রান্নাবান্না করতে যে পানি দরকার তার জন্য পুকুর ব্যবহার করা হত। কিন্তু পৌরসভা এলাকায় এখন পুকুর নেই বললেই চলে। পৌরসভা কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে কোনো গুরুত্ব দিচ্ছে না।
যশোর শহরের চোরমারা দীঘির পাড় এলাকার অনেকেই জানিয়েছেন, তারা ২৫/৩০ বছর বসবাস করছেন ওই এলাকায়। বিশালাকার এক দীঘির কারণে এলাকার নামকরণ করা হয়েছিল চোরমারা দীঘির পাড় এলাকা। সে দীঘিটি ভরাট করে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলা হয়েছে। বহুতল ভবনও হয়েছে কয়েকটি। ওই পুকুরটি দৈনন্দিন নানা কাজে লাগত।
এদিকে পরিবেশ ও আবহাওয়াবিদরা বলছেন, পুকুর ও জলাশয় ভরাট হয়ে যাওয়ায় যশোর জেলায় দেখা দিয়েছে প্রাকৃতিক পরিবেশের নানা বিপর্যয়। তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে অসহনীয়। আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় তাপদাহ বেশি। জলাধার কমে যাওয়ায় নিচে নেমে গেছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর। পুকুর ও জলাশয় তাপ ধারন করে। পুকুর ও জলাশয়ে জলীয়বাস্প তাপমাত্রা ও পরিবেশের একটি ব্যালান্স রাখে।
যশোর সরকারি এমএম কলেজের ভূগোল বিভাগের অধ্যাপক ছোলজার রহমান জানিয়েছেন, এমনিতে এপ্রিল মে জুন প্রচন্ড গরমের মাস। এর আগে অব্যাহত পুকুর ও জলাশায় ভরাট করে এ অঞ্চলকে উত্তপ্ত হওয়ার পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে এবং মহল বিশেষের অপরিকল্পিত ও অদূরদর্শীভাবে পুকুর ও জলাশায় ভরাট করে গরমকে স্বাগত জানানো হয়েছে। দিনদিন তাপপ্রবাহ বাড়ছে। একটি অঞ্চলের মানুষের জন্য পুকুর বা জলাশয় অপরিহার্য্য। কিন্তু সাময়িক কিংবা স্বল্পমেয়াদি লাভের তাড়না ও লোভ-লালসায় জলাশয়গুলোকে গলা টিপে হত্যা করে হচ্ছে অব্যাহতভাবে। কোন পুকুর বা জলাশয় ভরাট করা যাবে, আর কোনটা একেবারেই যাবে না সে ধরনের কোনো সচেতনতা বা নির্দেশনা আমলে নেয়া হয়নি। যে পুকুরগুলো এখনও আছে, তা রক্ষা করা না গেলে ভবিষ্যতে পরিবেশের ভারসাম্য আরো হুমকিতে পড়বে। তাপপ্রবাহ আরো বাড়বে, দূর্বিসহ জীবন আসবে।
গ্রীন ওয়ার্ল্ড ফাউন্ডেশন যশোরের নির্বাহী পরিচালক আশিক মাহমুদ সবুজ জানিয়েছেন, যশোরে একে একে পুকুর ও জলাশয় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। বিগত সময়ে হাজার হাজার জলাধার ভরাট হয়েছে। এখন আর কিছু বাকি নেই বললেই চলে। এখন ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ পড়েছে পুকুর না থাকায়। এতে পানির স্তর নেমে যাচ্ছে। আর জলাধার না থাকায় ভূ-উপরিস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানির মধ্যে সাইকেলটি পূর্ণ হতে পারছে না। যার প্রভাবে পানি সংকট দেখা দিচ্ছে। তাপদাহ বাড়ছে। জলাধার ও পরিবেশ রক্ষার আইন আছে, কিন্তু তা বাস্তবায়ন হয় না।
এদিকে, এ ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর যশোরের উপ পরিচালক নুর আলম জানিয়েছেন, অপরিকল্পিত ও অদূরদর্শীভাবে এ অঞ্চলে পুকুর খাল নালা জলাশয় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। অথচ এসব পুকুর খাল বিল দীঘি ও জলাশয়ের পানি চুইয়ে ভূগর্ভস্থ পানির সাথে মেশে। এতে পানির স্তর নিচে নামা রোধ হয়। আবার তাপমাত্রাও কম থাকে। কেননা পুকুরের পানি তাপধারণ করে। যে কারণে তাপমাত্রা সহনীয় থাকতে সহায়তা করে। পুকুর কমে যাওয়ায় তাপমাত্রা বৃদ্ধির অন্যতম কারণ বলেও জানান তিনি। তবে পুকুর বা জলাশয় ভরাটের বিষয়ে তাদের কাছে অভিযোগ না আসলে সাধারনত অভিযান চালানো হয় না। পুকুর বা জলাশয় ভরাট হয়ে পরিবেশের উপর প্রচন্ড প্রতিকুল প্রভাব পড়ছে। জলজ প্রাণি বৈচিত্র্য রক্ষাও ব্যাহত হচ্ছে। গরম ও পরিবেশ সহনীয় রাখতে বাকি জলাশয়গুলোকে রক্ষা এখন খুবই প্রয়োজন। যশোরের কেউ পুকুর বা জলাশয় ভরাট করতে উদ্যোগী হলে তার দপ্তরে অভিযোগ করতে অনুরোধ করেছেন।
এ ব্যাপারে তিনি কার্যকরি ব্যবস্থা নেবেন। পরিবেশ আইনের আওতায় অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন।