
করোনার প্রাদুর্ভাবে ঘরবন্দী জীবন যাপনে হাঁপিয়ে উঠছে শিশুরা। অনিশ্চিত এ পরিস্থিতিতে শিশু সন্তানদের মানসিক বিকাশ নিয়ে দিন দিন শংকা বাড়ছে অভিভাবকদের। অবরুদ্ধ জীবন থেকে একটু মুক্ত আলো হাওয়া ও মানসিক প্রশান্তির জন্য প্রকৃতির সান্নিধ্য পেতে কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করছে শিশু ও অভিভাবকবৃন্দ।
করোনা ভাইরাসের প্রভাবে সাধারণ ছুটির সূত্র ধরে প্রায় দুইমাস হলো সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। সাংস্কৃতিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং কোচিং সেন্টারগুলোতেও ঝুলছে তালা। একই অবস্থা যশোরের পার্ক ও বিনোদন কেন্দ্রগুলোর। স্কুল, কোচিং, টিউশন, হোমওয়ার্ক, ছুটির দিনে বাইরে আনন্দ কিংবা আত্মীয়ের বাড়িতে যাওয়া এটাই ছিল স্বাভাবিক জীবনের রুটিন। করোনায় সাধারণ ছুটির প্রথম দিকে জীবনের নিয়মিত রুটিনের ছন্দপতন হওয়াতে সকল শিশুই তা উপভোগ করছিলো। কিন্তু এখন এ জীবন তাদের কাছে বন্দী দশা। প্রতিদিনের একই পরিবেশ, একই খেলনা, খাবারের তাগিদ, ঘুম, খেলাতে বিরক্ত শহর ও গ্রাম সকল স্থানের শিশু। তবে সবথেকে বিপাকে শহরের শিশুরা। স্বাভাবিক জীবন থমকে গেছে। বাইরে যেতে না পেরে অস্থির হয়ে উঠছে তারা।
পাঁচ বছরের শিশু স্বচ্ছ বিশ্বাস, যশোর সেঞ্চুরী প্রি ক্যডেট স্কুলে নার্সারী শ্রেণির ছাত্র। এইচ এমএম রোডের একটি বাড়ির চারতলায় স্বচ্ছের পরিবার বাসবাস করে। আগে স্কুলে যাওয়ার জন্য বাসা থেকে বের হতে হতো। নিচে নামার সুযোগ পেত সে । এখন তা বন্ধ। ঘরবন্দী থাকতে থাকতে তিক্ত হয়ে উঠেছে শিশুটি। তার মা পলি সাহানী বলেন, স্বচ্ছের এখন বাড়ন্ত বয়স। এখনি সময় মেধা বিকাশের কিন্তু বন্দী দশায় তার ব্যাঘাত ঘটছে। স্কুল ছুটি হওয়ায় বাসায় কয়েক দিন খুবই হাসি খুশি ছিলো। দীর্ঘ দিন স্কুল ছুটি আর ঘরে বন্দী থাকায় শান্ত মেজাজের ছেলেটি দিন দিন অশান্ত ও খিটখিটে হয়ে উঠছে।
সম্মিলনী ইনস্টিটিউটের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র অঞ্জন হালদার, অষ্টম শ্রেণির নিলয় হালদার, কালেক্টরেট স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র সন্দিপ বিশ্বাস, জিলা স্কুলের সাদাত সাইমুন, আরাফাত শোভন জানায়, টেলিভিশন ও অনলাইনের মাধ্যমে বাবা-মায়ের তত্ত্বাবধানে তারা পড়াশোনা করছে। এর বাইরে পুরো দিনের সময় কাটানো অনেক কষ্টের। টিভি দেখা আর মোবাইল ফোন ব্যবহার করাও এখন একঘেয়েমি হয়ে যাচ্ছে। বাইরে বের হওয়া যাচ্ছে না। বাড়ির বাইরে নিরিবিলি পরিবেশে কিছুক্ষণ কাটাতে পারলে ভালো হয় সবসময় এমনটা মনে হচ্ছে বলে জানায় তারা।
পৌর পার্কসহ স্কুল কলেজ মাঠগুলো এখন তালাবন্ধ। অনেক স্কুল কলেজ মাঠে বসেছে বাজার। জেলা প্রশাসন ও পৌরসভা কর্তৃপক্ষের প্রতি পার্ক বা স্কুল কলেজ মাঠে নির্দিষ্ট শারীরিক দুরত্ব বজায় রেখে খেলাধূলা বা চলাফেরার সুযোগের অনুমতি প্রার্থনা করে এ শিশুরা।
মুজতাহিদ আহমেদ ও রেহানা রজনী নামে দু’জন অভিভাবক বলেন, মনোবিদরা বলছেন সন্তানদের দিনযাপনে বৈচিত্র আনা খুবই দরকার। বাইরে যাওয়া যাবে না তাই ঘরেই কৌশল ও পরিকল্পনা দিয়ে শিশুদের একঘেয়েমিতা দূর করতে হবে। কিন্তু বর্তমান অর্থনৈতিক ও সমাজিক প্রেক্ষাপটে শিশুদের জন্য আলাদা করে ভাবা বা কার্যক্রম গ্রহণ করার মতো অভিভাবক হাতে গোণা। আগেই যেখানে শিশুদের মন নিয়ে অনেকে ভাবেননি এখন সেটা চর্চা করা আরো কঠিন। দেশের ভবিষ্যৎ সুস্থ স্বাভাবিক নাগরিকের স্বার্থে এ বিষয়ে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে বিশেষ চিন্তাশিল হয়ে সময়োপযোগী এবং যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে বলে মত দেন তারা।
যশোর জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা সাধন দাস বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে দেশের শিশুদের মানসিক ঝুঁকি বিরাজ করছে এটা অস্বীকার করা যাবেনা। গ্রামে বসবাসরত পরিবারের শিশুরা মুক্ত বাতাস ও খোলা জায়গায় চলাচল করার সুযোগ পাওয়ায় তাদের মানসিক বিকাশে তেমন ঝুঁকি নেই। কিন্তু শহরের শিশুরা বিপাকে আছে। তবে তারা পরিবেশের সাথে খাপ খায়িয়ে চলছে যা বড়দের জন্য শিক্ষণীয়। সুস্থতার খাতিরে করোনা প্রতিরোধে যেখানে একটি শিশু সকল আচরণ বিধি মেনে চলছে সেখানে অনেক বড় মানুষ তার ব্যতিক্রম করছে। এটাও একটি শিশুর জন্য মনোকষ্টের কারণ হতে পারে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিশুদের শুধু শিশু বলে ধরলে হবে না। বয়স ভেদে একেবারে ছোট্ট শিশু, প্রাক বয়ঃসন্ধি, বয়ঃসন্ধি কালীন, প্রাক স্কুলগামী, স্কুল গামী এ হিসেবে তাদের বিভিন্ন ভাবে ভাগ করা যায়। এই বিশেষ পরিস্থিতিতে সকল শিশুই নিরাপত্তা এবং সুস্থতা নিয়ে চিন্তিত। তার উপর জীবনাচারণেও এসেছে পরিবর্তন। সন্তানের সুন্দর আগামীর জন্য এ পরিস্থিতিতে অভিভাবকসহ সকলকেই সচেতন থাকতে হবে। বিশেষ করে শিশুদের সৃজনশীল গুণাবলীকে এখন উৎসাহিত করতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে খাদ্যাভাসের প্রতি। প্রকৃতির কাছাকাছি থেকে মানবিক গুণাবলী বিকাশেও হতে হবে সহায়ক।