
--------------------
সারাদিনই প্রায় মেঘলা আকাশ, মাঝে মাঝে একটু হীরক চূর্ণ রোদের ঝিলিক আর
হটাৎ হঠাৎই ঝমঝমিয়ে খানিক বৃষ্টি। দু-একবার অনাহুতের মতো দমকা বাতাস ঘরে
ঢুকে এলোমেলো করে দিচ্ছে জানালার পর্দা, খোলা চুল, শান্ত মন। মনের কথাই যদি
বলি, তাহলে সে তো কখনোই শান্ত নয়! বাতাস তাকে কি এলোমেলো করবে, সে তো
নিজেই ঘটনঅঘটন-পটিয়সী, চঞ্চলা ছিন্নমতি, বাউণ্ডুলে। তার বায়নার শেষ নেই।
বাহানাও অন্তহীন। কোন মূর্তিতে কখন কোথায় বিরাজ করে তা বোঝে কার সাধ্য!
বর্তমানের এই করোনা উপসর্গ নিয়ে প্রতিদিনের সংবাদ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু মন ভীষণ বিরক্ত। করোনা ভাইরাস এর আস্ফালন, মৃত্যু, লকডাউন ভোগান্তি
সবকিছু মিলিয়ে তার তিরিক্ষি মেজাজ যেন সপ্তমে চড়ে আছে। এসব সে শুনতে চায়
না, মানতেও চায় না। সময়ের বিধি নিষেধকে পাত্তা দিতে সে একেবারেই নারাজ।
করোনার সাথে তার সোজাসাপটা কথাবার্তা। করোনাকে সময় বা পাত্তা দেয়ার কোন
ইচ্ছেই তার নেই। কোন দেশ থেকে উদ্বাস্তু অনামুখো উড়ে এসে জুড়ে বসে ঘেটি ধরে
বলবে চলো আমার সাথে, তোমার ভবলীলা সাঙ্গ। বললেই হলো! এইসব অনাসৃষ্টি
আবদারের কোন মানে হয়! যত্তসব মাথামোটা, চক্ষু কর্ণের চামড়া পুরু অবাঞ্ছিতের
স্বেচ্ছাচার। সবচেয়ে বড় কথা এত মানুষের চেষ্টা, পরিশ্রম, সচেতনতা ব্যর্থ
করে দিনের পর দিন যেন জাঁকিয়ে বসে মানুষের প্রাণ নিয়ে খেলা করছে। মন এর
যুক্তি হলো এখনই সব ছেড়ে ছুঁড়ে করোনার হাত ধরে বেরিয়ে পড়ার সময় তার নেই।
হ্যা যেতে হবে তো বটেই! সবাইকেই যেতে হয়। তাই বলে করোনার মত পরজীবি বেহায়ার
পাল্লায় পড়ে! মন কিছুতেই মানতে পারে না আর তখনই সে অস্থির হয়ে ওঠে। তার
অনেক কাজ জমে আছে। ভেবে পায় না কত সময় নষ্ট হয়ে গেল! কত কি লেখা এখনো বাকি।
কত কত কাজের হিসাব মেলানো হয়নি। কত জায়গায় যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল , সে সব
বাদ দিয়ে করোনা বললো ওঠ ছুড়ি তোর সময় শেষ, আর হয়ে গেল সবকিছুর অবসান! আমি
মনকে শান্ত হতে বলি। বলি সব কাজ শেষ করতে পারবে তুমি। শুধু ধৈর্য আর মনোবল
ঠিক রাখো। অস্থির মানসিকতা সব পরিকল্পনা ভন্ডুল করে দেয়। যাবে তুমি--
নিশ্চয়ই যাবে, মেঘের মত উড়ে যাবে, দূরে-- বহুদূরে। যেখানে তুমি যেতে চাও।
বাংলাদেশের সবগুলি জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে যেখানে নির্ভেজাল আঞ্চলিক ভাষায়
মানুষ কথা বলে সেখানে যাওয়ার বায়না তার বহুদিনের। শুনবে তাদের কথা। তারা
নিকোনো উঠোনে মাটির চুলোয় রান্না করতে করতে বলবে জীবনের গল্প। শুনবে কৃষকের
জমি চাষের নিপুণ শৈল্পিকতা। শুনতে হবে জেলেপাড়ার দক্ষ জেলেদের মাছ ধরার
গল্প, আরো কত কি, সেসব একবারে লিখে শেষ হবে না। রংপুরের কি মায়াভরা মিষ্টি
ভাষা-- ‘জাগো বাহে কোনঠে সবাই’। ‘তুই হামাক বাড়িত বেড়াইতে আইসেন’ বলেছিল
নব্বই দশকে অভাবের তাড়নায় রংপুর থেকে চলে আসা একটি দরিদ্র পরিবারের গৃহিণী।
কোথায় তারা, চেনা জগৎ থেকে সেই কবেই হারিয়ে গেছে শুধু সেই আমন্ত্রণটি রয়ে
গেছে বুকের ভিতর। যেতে হবে নিধুয়া পাথারে মৈষাল বন্ধুর সেই ভাওয়াইয়া গানের
দেশে, মঙ্গা কবলিত গাড়িয়াল ভাইয়ের গরুর গাড়ি বহরের পথ ধরে। নোয়াখালী,
চিটাগাং এর পারিবারিক কথোপকথন শুনবে গালে হাত দিয়ে বসে। হয়তো কিছুই বুঝবে
না আবার হয়তো বুঝে ফেলবে সবটুকু ভালোবাসার, খুনসুটির অথবা পাওয়া না পাওয়ার
সুখ-দুঃখের অনুভূতি। রাঙামাটি, খাগড়াছড়ির পাহাড়ি জীবন, জলের কলসি মাথায়,
পিঠে ছেলে-মেয়ে ঝুলিয়ে পাহাড় বেয়ে ওঠা কঠিনতর সেই জীবনের গল্প। বান্দরবানের
মেঘকন্যার গান, সিলেটের চা শ্রমিকদের সারাদিনের কাজ শেষে রান্নার আয়োজন যে
তাকে দেখতেই হবে খুব কাছ থেকে। এমনি বাংলাদেশের আটষট্টি হাজার গ্রামের
গল্প যে তাকে শুনতে হবে। তাই মন অস্থির হয়। সেই ফাল্গুন থেকে এই শ্রাবণ
পৃথিবী জুড়ে চলছে করোনা ভাইরাস এর তান্ডব লীলা। ফাল্গুনে এবার রঙ লাগেনি,
জমেনি পয়লা বৈশাখ! সর্বত্র ভয় ভয়, জীবন যেন থমকে গেছে মৃত্যুর মুখোমুখি
দাঁড়িয়ে। নিজেকে চারদেয়ালের ভিতরে আটকে রাখতে রাখতে মন বিদ্রোহ করে ওঠে।
একদিন সব ভয় দূর করে সে নিশ্চয়ই মিশে যাবে জনজীবনের সঙ্গে।