
যশোর শিল্পকলা একাডেমি সৃষ্টি করল আরও এক নতুন ইতিহাস। এ ইতিহাস শুধু করোনাকালের দীর্ঘ বিরতির পর যশোরের সংস্কৃতিকজনদের এক মঞ্চে আনার নয়-আবেগ, স্মৃতিচারণ আর মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নতুন করে উজ্জীবিত হয়ে সামনে এগিয়ে চলার প্রত্যয়েরও। যার অনুপ্রেরণা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু অ্যালেন গিন্সবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। কালজয়ী ও ঐতিহাসিক এই কবিতাকে উপজীব্য করে মঞ্চস্থ হওয়া গীতিনৃত্যনাট্যের নামও দেওয়া হয়েছে ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’।
ঐতিহাসিক এ মুহূর্তের সাক্ষী হতে শুক্রবার হাজারো দর্শকের সমাগম ঘটে জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে। নির্দিষ্ট আসন পূর্ণ হওয়ার পরও শ’ খানেক দর্শক দাঁড়িয়ে উপভোগ করেছেন সম্পূর্ণ আয়োজন। উপস্থাপনার গভীরতায় চোখে জল আর পরিতৃপ্তির হাসি দুটোই নিয়ে ফিরেছেন সকলে।
‘শত শত চোখ আকাশটা দেখে, শত শত শত মানুষের দল, যশোর রোডের দুধারে বসত বাঁশের ছাউনি কাদামাটি জল। কাদামাটি মাখা মানুষের দল, গাদাগাদি করে আকাশটা দেখে, আকাশে বসত মরা ঈশ্বর, নালিশ জানাবে ওরা বল কাকে। ঘরহীন ওরা ঘুম নেই চোখে, যুদ্ধে ছিন্ন ঘর বাড়ি দেশ, মাথার ভিতরে বোমারু বিমান, এই কালোরাত কবে হবে শেষ। শত শত মুখ হায় একাত্তর যশোর রোড যে কত কথা বলে, এত মরা মুখ আধমরা পায়ে পূর্ব বাংলা কোলকাতা চলে।’ মৌসুমী ভৌমিকের এ গানের সাথে উপস্থাপিত অংশে মিলনায়তনের দর্শক যেন ফিরে যান সেই একাত্তরের যশোর রোডে। যারা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্ম তারাও অনুধাবন করেছে ১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশের শরণার্থীরা এই রাস্তা ধরে ভারতে পাড়ি জমাচ্ছিল। তখন এই রাস্তাটিই ছিল তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র স্বপ্ন পূরণের পথ। তাদের অনেকেই পথ চলার ক্লান্তি সহ্য করতে না পেরে ঢলে পড়েছিলেন মৃত্যুর কোলে। এই রাস্তার প্রতিটি ধুলিকণাও যেন সেই লাখো শরণার্থীর ক্লান্তি, দুর্ভোগ ও বয়ে বেড়ানো স্বপ্নের সাক্ষী।
মাত্র ৪৫ মিনিটের গীতিনৃত্যনাট্যে ব্রিটিশ রাজ ও পাকিস্তানি অত্যাচার, জেল জুলুম হত্যার বর্ণনা, নানা আন্দোলন সংগ্রামের কাহিনী সুনিপুণভাবে উপস্থাপিত হয়েছে। নতুন করে প্রাণ সঞ্চার করেছে মহান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সেই ঐতিহাসিক ভাষণও। গীতিনৃত্যনাট্যের সার্বিক পরিকল্পনা গ্রন্থনা ও পরিচালনায় ছিলেন সুকুমার দাস। তাকে সহযোগিতা করে সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড গানের অংশে নির্দেশনা দিয়েছেন কামরুজ্জামান তাপু। নাট্যাংশের পরিচালনায় ছিলেন কামরুল হাসান রিপন। নৃত্যাংশ সাজিয়েছেন সঞ্জীব চক্রবর্তী ও খাদিজা ইসলাম তন্বি। ভিডিও সম্পাদনায় ছিলেন অসীম সাহা। শব্দ প্রক্ষেপন করেন সাঈদ আমীন। একক সঙ্গীত পরিবেশন করেন রফিকুল ইসলাম এবং একক আবৃত্তি করেন আব্দুল আফফান ভিক্টর, আলোক সম্পাতে ছিলেন আসিফ খান।
স্মৃতির পরতে পরতে জমে থাকা ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ নামের ইতিহাস যশোর শিল্পকলা একাডেমির মঞ্চে উপস্থাপনের মূল ভাবনায় ছিলেন জেলা প্রশাসক তমিজুল ইসলাম খান। আয়োজনের শেষে তার আবেগ আপ্লুত অনুভূতি জানান দেয় পূর্ণ আয়োজনের অংশ হতে পারা কতখানিক গৌরবের। যে গৌরবের হাসি হেসেছেন সুকুমার দাসও। সকলকে এ আয়োজনে অংশ নেওয়ার জন্যে ধন্যবাদ জানান শিল্পকলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহমুদ হাসান বুলু।
জেলা প্রশাসন আর শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে এই প্রদর্শনী ভার্চ্যুয়ালি উপভোগ করার সুযোগ পেয়েছেন লাখো দর্শক। যশোর সিটি ক্যাবল সরাসরি সম্প্রচার করে এই গীতি নৃত্যনাট্য। একইসাথে জেলা প্রশাসন যশোরের ফেসবুক পেইজ থেকে লাইভ করা হয়। গ্রামের কাগজের ফেসবুক পেইজ থেকেও দর্শকদের আয়োজনটি উপভোগের সুযোগ করে দেওয়া হয়।