
(পূর্ব প্রকাশের পর)
উনিশ শতকে বাংলার রেনেসাঁর অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বাংলায় শিক্ষার আধুনিকায়ন ও বিস্তার, এবং নারী শিক্ষার প্রবক্তাই শুধু তিনি ছিলেন না, সেই সাথে তিনি ছিলেন এক মহান সমাজ সংস্কারক। ইতিপূর্বে রাজা রামমোহনের বহুমুখী চেষ্টায় হিন্দু সমাজের মধ্যে প্রচলিত নারীর প্রতি সবচেয়ে অমানবিক বিধান ‘সতীদাহ প্রথা’ ১৮২৯ সালে সরকারি আইনবলে নিষিদ্ধ হয়। এছাড়া আরো কিছু কুসংস্কার সে সমাজে প্রচলিত ছিল।
সে যুগে হিন্দু সমাজব্যবস্থায় বিধবা নারীদের পুনরায় বিবাহের কোন প্রচলন ছিল না। বিধবা সে যে বয়সেরই হোক না কেন এই কুপ্রথা তাকে সারাজীবন বিধবা থাকার গ্লানি ভোগ করতে বাধ্য করত। হিন্দু আইনে একেতো নারীর পিতা বা স্বামীর সম্পত্তিতে কোন অধিকার নেই। তার ওপর বিধবা হলেতো কথাই নেই। তখন বাল্য বয়সে বিয়ের প্রচলন থাকায় স্বামীর মৃত্যুর কারণে হাজার হাজার নারীকে তরুণী বা যুবতী অবস্থায় অকাল বৈধব্যের শিকার হয়ে স্বামী অথবা পিতার বাড়ীতে লাঞ্ছনাময় জীবনকে বেছে নিতে হত। কিন্তু তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজ- সে পুত্রবধূ হোক, আর কন্যাই হোক আপন নারীর এই অবমাননায় মোটেই বিচলিত ছিল না। সমাজপতিদের প্রচারণায় সাধারণ মানুষ এই অমানবিক বিধানকে অলঙ্ঘনীয় ধর্মীয় বিধান হিসেবে মনে করত। অসহায় বিধবাকুলের চাঁপা আর্তনাদে বিদ্যাসাগরের দয়াদ্র মন কেঁদে ওঠে। তিনি সরকারি আইনের মাধ্যমে বিধবাবিবাহ প্রচলন করার সংগ্রামে নেমে পড়েন।
প্রথমে হিন্দুশাস্ত্র ঘেঁটে দেখেন এই কুপ্রথার অলঙ্ঘনীয়তা সম্পর্কে। পেয়ে যান বিধবাবিবাহের সপক্ষে বিধান। শুরু হয় রক্ষণশীল শাস্ত্রীয় পন্ডিতদের সাথে তাঁর তর্কযুদ্ধ। এ নিয়ে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রবন্ধ লিখে চলেন একের পর এক। বিধবাবিবাহের সপক্ষে পরপর দুটি বই লিখে তা হাজার হাজার কপি প্রকাশ করে অসচেতন সমাজকে নাড়িয়ে দেন। পরে শুরু করেন রাজদরবারে দেন দরবার। বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠে রক্ষণশীল কুলীন সমাজ। পত্র পত্রিকায় অজস্র গাল-মন্দসহ লেখালেখি শুরু হয় তাঁর বিরুদ্ধে। বিদ্যাসাগরকে ব্যঙ্গ করে গান রচিত হয়। তবুও তিনি নিজ সংকল্পে অবিচল থেকে আন্দোলন চালিয়ে যান। একসময় ৯৮৬ জন ব্যক্তির স্বাক্ষরসহ এক আবেদনপত্রে সরকারের নিকট বিধবাবিবাহের সপক্ষে আইন পাশের দাবী জানান। বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধবাদীরা ছিল সংখ্যায় অধিক। তারা ৩৩ হাজার লোকের স্বাক্ষর সম্বলিত স্মারকলিপিতে বিধবা বিবাহের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। শুরু হয় সরকারের উচ্চ মহলে এর পক্ষে বিপক্ষে বিবিধ আলোচনা। শেষ পর্যন্ত বিদ্যাসাগরের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় ১৮৫৬ সালের জুলাই মাসে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক হিন্দু বিধবাবিবাহ আইন পাশ হয়। সে সময়ে নারী নিপীড়ক আরেকটি কুপ্রথা ছিল হিন্দু পুরুষের বহুবিবাহ প্রথা।
প্রাচীন রীতি অনুযায়ী হিন্দু সমাজ সব সময় একই বর্ণের পাত্র-পাত্রীর মধ্যে বিবাহকে সমর্থন করে। বিদ্যাসাগরের যুগে অসবর্ণ অর্থাৎ ভিন্ন বর্ণের মধ্যে বিবাহকে পাপাচার বলে গণ্য করা হত। এই নিয়মের ব্যত্যয় হলে রক্ষণশীল সমাজপতিরা তার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিত। তখন ব্রাহ্মণ সম্প্রদায় কুলীন-অকুলীন দুইভাগে বিভক্ত ছিল। সমাজে কুলীন ব্রাহ্মণদের মধ্যে বিবাহোপযুক্ত পাত্রের সংখ্যা কম থাকায় ঐ সমাজের বিবাহযোগ্যা কন্যাদের উপযুক্ত পাত্রের সাথে বিবাহ দেওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। ওদিকে বিধানমতে ঘরে অনূঢ় কন্যা থাকাকে এক মহাপাপ বলে গণ্য করা হত। অনেক সময় বয়স্কা অবিবাহিতা মেয়ের বাবাকে একঘরে হয়ে নিজগ্রাম ত্যাগ করতে হত। সেকালে কন্যার বিয়ের জন্য পাত্রসংকট এমন পর্যায়ে পৌঁচ্ছেছিল যে অভিশপ্ত হওয়ার বিপদ থেকে পরিত্রাণের আশায় যোগ্য-অযোগ্য, বিবাহিত-অবিবাহিত, যুবক-বৃদ্ধ ইত্যাদি না বিচার করেই কুলীন ব্রাহ্মণ পিতারা তাদের ঘরের অনূঢ় কন্যাদের কুলীন ব্রাহ্মণ পাত্র পেলেই যৌতুকসহ বিয়ে দিয়ে দিতে থাকেন। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে এক শ্রেণীর মানবতাহীন কুলীনেরা নির্বিচারে ঘরে স্ত্রী সন্তান থাকা সত্ত্বেও যৌতুকের লোভে বহুবিবাহে নেমে পড়ে। মুখে থাকে তাদের কন্যাদায়গস্ত পিতাদের মহাপাপ থেকে উদ্ধারের কপট শ্লোগান।
একাজে ৬০ থেকে ৮০ বছর বয়সী বৃদ্ধরাও বসে থাকে না। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, ঘরে দুই তিনটা স্ত্রী ও তাদের ছেলেমেয়েদের অভূক্ত রেখে এক শ্রেণির কুলীন ব্রাহ্মণ বৃদ্ধরা নৌকা ভাড়া করে বেরিয়ে পড়ে গ্রামে গ্রামে অনূঢ় কুলীন মেয়েদের বিয়ে করে তাদের তথাকথিত পাপ থেকে মুক্তি দিতে। এক এক যাত্রায় একটার পর একটা বিয়ে করে সেই নববধূদের সাথে দু’চারদিন কাটিয়ে তাদেরকে যার যার বাপের বাড়ীতে রেখে শুধুমাত্র পণের টাকা ও যৌতুক নিয়ে একসময় বাড়ি ফিরে আসতো। পরের বছর আবার বেরিয়ে কিছু নতুন নতুন মেয়ে বিয়ে করে একই কায়দায় যৌতুক শিকার করতো, সেই সাথে পূর্বেকার শ্বশুর বাড়ীগুলি ঘুুরে বাৎসরিক খাওয়াপরার খরচ বা ধানচাল নিয়ে নৌকায় উঠতো। রক্ষণশীল সমাজপতিদের সমর্থনে কুপ্রথাটি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যে দেখা যায় বিবাহযোগ্যা মেয়েদের জন্য বর না পেয়ে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুপথযাত্রী কুলীনদের সাথে মেয়ে বিয়ে দিয়ে মেয়ের পিতা মাতা নীরব অশ্রুপাতের মধ্য দিয়ে নির্দয় সেই সামাজিক বিধান রক্ষা করছেন।
নারী নিষ্পেষণের এই জঘন্য বিধানের প্রতি বিদ্যাসাগর এত বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন যে সে সময় তিনি বাংলার কয়েকটি অঞ্চল ঘুরে সেখানকার কতিপয় নির্লজ্জ ব্রাহ্মণ সমাজপতির ব্যক্তিগত বহুবিবাহের তালিকা প্রস্তত করে তা জনসমক্ষে প্রকাশ করেন। সে তালিকায় একটি গ্রামের সাতজন কুলীন ব্রাহ্মণের তথ্যে দেখা যায় তাদের বয়স ৫০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে। তারা এক একজন সর্বোচ্চ ৭০ থেকে ৪০ জন করে অনূঢ় কন্যাকে বিয়ে করে তাদের নরকের দ্বার থেকে ফিরিয়ে এনেছেন। বিদ্যাসাগর তাঁর যুক্তি ও লেখনির মাধ্যমে এই ঘৃণিত প্রথা নিষিদ্ধ করার আন্দোলনে এগিয়ে আসেন। এবারও শাস্ত্র থেকে বিধান সংগ্রহ করে তা পুস্তকাকারে প্রকাশ করেন। রক্ষণশীলরা যথারীতি বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে নামে। শুরু হয় সরকারি মহলে দেনদরবার। কিন্তু সময়টা বিদ্যাসাগরের অনুকূলে ছিলনা। সেটা ছিল ১৮৫৭ সাল। সিপাহী বিদ্রোহের বছর। মহাবিদ্রোহের প্রবল আঘাতে তখন ইংরেজ শাসকরা ভীত সন্ত্রস্ত। তারা স্পর্শকাতর এই বিষয়ে হাত দিতে ভয় পেয়ে যায়। ফলে বিদ্যাসাগরের বহুবিবাহ প্রথা বিরোধী দাবী আইনগত স্বীকৃতি পেতে ব্যর্থ হয়। তবে পরবর্তীকালে যতদিন তিনি কর্মক্ষম ছিলেন সে আন্দোলন চালিয়ে যেতে পিছুপা হননি।
অভাবগ্রস্ত ও আর্তজনের প্রতি দয়া ছিল বিদ্যাসাগরের আর একটি মহৎ গুণ। সেকারণে তাঁকে অনেকে দয়ারসাগর বলে অভিহিত করেছেন। ১৮৬৫ সালে মারাত্মক খরার কারণে দেশে দুর্ভিক্ষ হলে বিদ্যাসাগর তাঁর নিজ গ্রামে অন্নছত্র খুলে স্বীয়গ্রামসহ আশেপাশের অনেক গ্রামের অনাহারী নরনারীকে কয়েক মাস ধরে আহার যুগিয়েছিলেন। ১৮৬৯ সালে বর্ধমান জেলায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপে মাহামারী হয়। বিদ্যাসাগর সেখানে উপস্থিত থেকে নিজ খরচে তাঁর ভাড়া করা বাসায় ডাক্তার বসিয়ে মানুষ বাঁচাবার ব্যবস্থা করেছিলেন। বিশেষ করে এক মুসলমান পাড়ায় অবস্থার অবনতি ঘটলে তিনি ঘরে ঘরে গিয়ে রোগী বের করে তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। সারাজীবনে বিদ্যাসাগর তাঁর অনেক পরিচিতজন, সহকর্মী ও বন্ধুবান্ধবদের অসুখ বিসুখ ও অভাবে সহায়তার হাত বাড়িয়ে গেছেন।
বিশেষ করে বাংলার মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়ে অর্থাভাবে ফ্রান্সে যেয়ে স্ত্রী সন্তানসহ চরম বিপদে পড়েছিলেন। সংসারের সব কিছু বিক্রি করেও অভাব না মেটায় ভয়ঙ্কর ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কবির জেলে যাবার উপক্রম হয়। সে বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্য মাইকেল বিদ্যাসাগরকে পরপর কয়েকটি চিঠি লেখেন। বিদ্যাসাগর প্রথমে নিজ থেকে দেড় হাজার, পরে ধার করে আট হাজার এবং সবশেষে আরো বারো হাজার টাকা পাঠিয়ে তাঁকে উদ্ধার করেছিলেন। সেই টাকা পেয়ে মধুসূদন ফ্রান্স থেকে লন্ডনে ফিরে গিয়ে ব্যারিস্টারি পড়ে দেশে ফিরে আসেন। ভালবেসে এতগুলি টাকা দিয়ে অন্যের উপকারের এমন দৃষ্টান্ত তখনকার সমাজে ছিল বিরল ঘটনা। যদিও মধুসূদন দেশে ফিরে এসে তাঁর পৈত্রিক জমির পত্তনিদারের কাছ থেকে জমি উদ্ধার করে তা বিক্রি করে বিদ্যাসাগরের সে ঋণ পরিশোধ করেছিলেন। বিদ্যাসাগর পরিচিত অনেক অভাগ্রস্ত লোককে মাসে মাসে মাসোহারাও দিতেন।
(চলবে)