
এই ধর্ষিত জনপদ আমার অচেনা মনে হয়। শস্য-শ্যামল, সবুজ সৌন্দর্যে ভরা আমার সোনার বাংলা ধর্ষকের অনায়াস বিচরণ ক্ষেত্র হতে পারে না। নয়মাস রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারী আজ অসহায়। তাদের সম্মান আজ ভূলুণ্ঠিত। এই স্বাধীন জনপদে দুই বছরের শিশু থেকে ষাট বছরের বৃদ্ধা নির্বিবাদে ধর্ষিত হয়! কোন নারীই নিরাপদ নয়। প্রতিদিন কোন না কোন নারী ধর্ষিত হচ্ছে।
সমীক্ষা বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ৮৮৯ জন নারী ধর্ষিত হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার ৪১ জন। সেই হিসাবে চলতি বছর প্রতি মাসে গড়ে ১১১ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এই তথ্য মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক)। তাছাড়া এই তালিকায় শিশু, কিশোরী, ছাত্রী, গৃহবধূ কে নেই! মূল কথা হচ্ছে এরা নারী, ছোট হোক আর বড় হোক নারী মানেই নিরাপদ নয়। নারী মানেই ঝুঁকি পূর্ণ শরীর। আজ প্রতিটি কন্যাশিশুর অভিভাবক শঙ্কিত, প্রতিটি নারী শঙ্কিত। মোটামুটি সচেতন যে কোন মানুষ স্বীকার করবেন যে ধর্ষণ মাত্রার স্রোত আমাদের সভ্য সমাজের নৈতিক বোধকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জল নাক পেরিয়ে মাথার উপর দিয়ে গড়িয়ে গেছে। যে কোন উপায়ে ধর্ষণ বন্ধ হোক অথবা বন্ধ করতে হবে প্রতিটি সচেতন নাগরিকের এখন একটাই দাবি।
এই ধর্ষিত সমাজের বদল চাই। এই হোক প্রতি কণ্ঠের তীব্র প্রতিবাদ। এত কিছুর পর আমরা কি ভাবছি? ধর্ষণ কি অপ্রতিরোধ্য? যুগ যুগ ধরে একশ্রেণির নপুংসক, পুরুষ নামের কলঙ্ক ধর্ষণ করে যাবে, আর যে কোন বয়সের নারী ধর্ষিত হবে, লজ্জায় কুঁকড়ে যাবে, আত্মহত্যা করবে সেটা তো চলতে পারে না। মানুষ খুন বা হত্যা হলে আমরা বিচলিত হই, সমাজ নড়ে ওঠে। কিছু না কিছু প্রতিক্রিয়া নজরে আসে। কিন্তু ধর্ষণ হলে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন গুলো কিছুদিন আন্দোলন, প্রতিবাদ করলেও কিন্তু তাদের আসলে কিছু করার থাকে না। আইনের চোরাগলি পেরিয়ে বিচার এমন ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যায় যে আমরা বিস্মৃতির অতলে তলিয়ে যায়। সময় না যেতেই আবার নতুন কোন ধর্ষণের ঘটনা ঘটে, আবার নতুন করে কিছুদিন আমরা তৎপর হই, পুরনো সেই বিচারের কথা আর কেউ মনে রাখে না!
একজন ধর্ষিত নারী সারাজীবন কতটা গøানির ভিতর দিয়ে কাটায় তার খোঁজ আমরা কেউ রাখি না। আরো একটা ব্যাপার উল্লেখ করতেই হয়, সব পুরুষ ধর্ষক নয়, সব পুরুষ নির্যাতন করে না। কিন্তু কিছু অমানুষের দায়ে সব পুরুষ মানুষেরই মাথা হেঁট হয়। ধর্ষণ করে একজন, আর হাজারো পুরুষ লজ্জা পায় মা, বোন, কন্যা বা নারী জাতির সামনে। মানুষ হিসেবে লজ্জিত হই আমরা সবাই। ধর্ষকও কোন মায়ের সন্তান, লজ্জা সেই মায়ের। ধর্ষককে জন্ম দেয়ার অপরাধে লজ্জা যেন সকল নারীর। তাই বলি ধর্ষণ কি প্রকারান্তরে খুন নয়? একজন নারীর জীবনে ধর্ষণ মৃত্যুর থেকেও ভয়ংকর। জীবন্মৃত অবস্থায় কাটাতে হয় সারাজীবন। নিজে ভোলার চেষ্টা করলেও সমাজ, চারপাশের মানুষ তাকে ভুলতে দেয় না কোনদিন। এই গøানি নিয়ে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত কাটাতে হয় সমাজের অপাংতেয় হয়ে। হোক সে শিশু থেকে বৃদ্ধা। বর্তমান পরিস্থিতি ধর্ষণ ভীতি কন্যা সন্তানের অভিভাবকদের সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন সকল নারী। এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতেও কি গা ঝাড়া দিয়ে উঠবে না সমাজ, সরকার, রাষ্ট্রের প্রতিনিধি গন! দেশের মানুষ!
প্রতিবাদ থেকে প্রতিরোধ জরুরী। আর যেন এমন ঘটনা না ঘটে, এ কথা আমরা প্রায়ই বলি। কিন্তু রাতারাতি দেশ এই হিংস্র পশুশূন্য হয়ে যাবে না। তাই স্বল্প থেকে সুদূর প্রসারি চিন্তা ভাবনা আমাদের এখনি করা দরকার। ধর্ষণ বিষয়ে মনস্তাত্তি¡ক গবেষণা ও পরিকল্পনা করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতের ধর্ষক তৈরি না হয়। প্রতিটি মহল্লায়, প্রতিটি পরিবার, প্রাইমারী থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, নির্যাতন বিরোধী ধারাবাহিক কাউন্সিলিং এর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিৎ বলে আমি মনে করি। সেই সাথে যে সকল ঘটনা ঘটছে তার উপযুক্ত বিচার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা অতি দ্রæত সময়ে করতে হবে।
সময়ক্ষেপণ ও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে নিম্ন রুচির মানুষের ভিতর এই অপরাধ এবং শাস্তির ভয় কমে যাচ্ছে। যা ধর্ষণ স্পৃহা বৃদ্ধি পেতে সহায়তা করছে। প্রতিটি ধর্ষণ মৃত্যুর সমান। সেইটা মাথায় রেখেই যথপোযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।
ধর্ষণ প্রতিরোধে প্রতিটি পরিবার থেকে সোচ্চার ও সচেতন ভূমিকা পালন করতে হবে। এই দায়বদ্ধতা আমাদের সকলের। এই দায়বদ্ধতা রাষ্ট্রের, সমাজের এবং প্রতিটি মানুষের।
# লেখক: নারী নেত্রী ও কলাম লেখক