এম. আইউব

শত চেষ্টা করেও আলু-চালের দামে লাগাম টানতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। নিত্য প্রয়োজনীয় এ দু’টি পণ্যের দাম কমানোর কথা বললেই বৃদ্ধি পাচ্ছে! কর্মকর্তাদের নির্দেশনার পরপরই মজুতদাররা দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন ইচ্ছেমতো। অবস্থা এমন পর্যায়ে গেছে যে, সাধারণ মানুষ বলছেন, ক্রেতারা পারলে খাদ্যপণ্য কিনবে, না পারলে না খেয়ে থাকবে। এক কথায় আলু এবং চালের দামে লাগাম টানতে পারছেন না সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। আর আগুনে পুড়তে হচ্ছে সাধারণ মানুষকে।
যশোরে বর্তমানে আলু বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকা কেজি দরে। আর এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজি চালে বেড়েছে কমপক্ষে চার টাকা। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের জেলা বাজার কর্মকর্তা সেপ্টেম্বর মাসের শুরুতে আলুর দাম নির্ধারণ করে দেন। হিমাগারের সামনে লাল শালু কাপড়ে লিখে দেন পাইকারি ২৩ টাকা এবং খুচরা সর্বোচ্চ ৩০ টাকায় আলু বিক্রি করতে হবে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। একদিনের জন্যেও ওই দামে আলু বিক্রি হয়নি। কেবল দাম বেধে দেওয়া হয়নি, হিমাগার মালিক ও আড়তদারদের সাথে দফায় দফায় সভা করেন এই কর্মকর্তা। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। তিনি যখন দাম বেধে দিয়েছিলেন তখন খুচরা বাজারে আলু বিক্রি হচ্ছিল ৩৫-৩৬ টাকা। ওই সময় গ্রামের কাগজকে জানানো হয়, যশোরে যে পরিমাণ আলু মজুত ছিল তা কমপক্ষে দু’ মাসের চাহিদা মেটাবে। অথচ দিনের পর দিন আলুর দাম বেড়ে চল্লিশে গিয়ে ঠেকেছে। খুচরা বিক্রেতারা জানিয়েছেন এ বছর নাকি আলুর দাম ৫০ টাকা হতে পারে! তাদের অভিযোগ, মজুতদাররা কারসাজি করে আলুর দাম বাড়াচ্ছেন। প্রশাসনের বাস্তব অর্থে তেমন কোনো তদারকি না থাকার কারণে এ অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন খুচরা বিক্রেতারা। খলিলুর রহমান নামে একজন খুচরা বিক্রেতা বলেন, মঙ্গলবার তাদেরকে আড়ত থেকে ৩৭-৩৮ টাকায় আলু কিনতে হয়েছে। এ কারণে ৪০ টাকার নীচে তাদের বিক্রি করার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, এক বস্তা আলুতে কমপক্ষে পাঁচ কেজি নষ্ট আলু থাকে। এরপর আছে পরিবহন খরচ।
এ বছর হিমাগারে যখন আলু রাখা হয়, তখন দাম ছিল মাত্র ১৪ টাকা। এরপর প্রতি কেজিতে হিমাগার ভাড়া বাবদ ৩.৬৬ টাকা, বাছাই খরচ ৪৫ পয়সা ও ওয়েটলস বাবদ ৮৮ পয়সা খরচ হয়। সবমিলিয়ে প্রতি কেজি আলুতে খরচ পড়ে ১৮.৯৯ টাকা। এতে সংরক্ষণকারীরা কেজিতে লাভ করেন ৩.৫১ টাকা। এ তথ্য খোদ সরকারি কর্মকর্তাদের।
গত এক মাসের বেশি সময় ধরে যশোরের বাজারে আলুর দাম হু হু করে বাড়ছে। এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে ভোক্তাদের মধ্যে। আলুর দাম নাগালে আনতে আগস্টের মাঝামাঝি মাঠে নামে কৃষি বিপণন অধিদপ্তর। এ অধিদপ্তরের জেলা বাজার কর্মকর্তা প্রত্যেক কোল্ডস্টোর কর্তৃপক্ষকে পত্র দেন। বাজার স্থিতিশীল করতে মজুতকৃত আলু বিক্রির নির্দেশ দেওয়া হয় ওই পত্রে। একইসাথে তিনি মামলা এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার হুঁশিয়ারিও দেন। কিন্তু এসব ছিল বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরোর মতো। কর্মকর্তারা ছিলেন কাগুজে বাঘ। ভোক্তার কোনো কাজে আসেনি তাদের হুঙ্কার। উপরন্তু মজুতদার এবং আড়ত ব্যবসায়ীরা লাগামহীনভাবে আলুর দাম বাড়িয়েছে। আর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এটি অসহায়ের মতো দেখতে হচ্ছে।
এ বছর যশোরে বাণিজ্যিকভাগে আটটি কোল্ডস্টোরে সংরক্ষণ করা হয় খাবার আলু। এই আটটি কোল্ডস্টোরে সর্বমোট ৩৬ হাজার সাতশ’ ৪৫ মেট্রিকটন আলু মজুত করা হয়। জেলা বাজার কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, এআরএ রাজারহাট কোল্ডস্টোরে দু’ হাজার একশ’ ৫০ মেট্রিকটন, টাওয়ার কোল্ডস্টোরে চার হাজার ছয়শ’ ৫০ মেট্রিকটন, সেনাকল্যাণ কোল্ডস্টোরে চার হাজার মেট্রিকটন, রজনীগন্ধ্যায় ছয় হাজার আটশ’ মেট্রিকটন, আলী কোল্ডস্টোরে এক হাজার পাঁচশ’ মেট্রিকটন, ডিভাইন কোল্ডস্টোরে চার হাজার নয়শ’ মেট্রিকটন ও সুন্দরবন কোল্ডস্টোরে এক হাজার সাতশ’ ৪৫ মেট্রিকটন আলু সংরক্ষণ করেন পেশাদার মজুতদাররা।
জুলাই মাস পর্যন্ত যশোরে পাইকারি ২৩-২৪ টাকায় আলু বিক্রি হয়। আগস্ট মাসে দাম আরও বাড়ে। মজুতদাররা হিমাগার থেকে পাইকারি ২৮ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি করে সেপ্টেম্বর মাসে এসে। এরপর ধীরে ধীরে দাম বেড়েই যায়। বর্তমানে আলু খুচরা ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
একই অবস্থা চালের ক্ষেত্রেও। সরকার সম্প্রতি চালের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। চালের দামও বেড়েই চলেছে। গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে প্রতি কেজিতে বৃদ্ধি পেয়েছে কমপক্ষে চার টাকা। বর্তমানে খুচরা বাজারে গরিবের চাল অর্থ্যাৎ মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৪৬-৪৮ টাকায়। আঠাশ ৫২-৫৩, কাজললতা ৫২-৫৪, মিনিকেট ৫২-৫৬ ও বাসমতি ৫৬-৬০ টাকায়। গত দু’তিন দিনে প্রতি কেজি চালে নতুন করে দু’ টাকা করে বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বিক্রেতারা বলছেন।
নেছার উদ্দিন নামে একজন পাইকারি বিক্রেতা জানান, ধানের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় চালের দাম বেড়েছে। গত এক সপ্তাহে ধানের দাম না বাড়লেও চালের দাম বাড়ল কেন এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন সবকিছু সিন্ডিকেটের কারণে।
এসব বিষয়ে জেলা বাজার কর্মকর্তা সুজাত হোসেন খান বলেন, সরকার চালের দাম বেধে দিয়েছে কয়েকদিন হলো। যাচাই করে দেখা হচ্ছে কেউ নির্ধারিত মূল্যের বেশি বিক্রি করছে কিনা। প্রমাণিত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, ‘সারাদেশে যদি আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণ করা না হয় তাহলে কেবল যশোরে নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি। আমরা নিয়ন্ত্রণ না করলে আলুর দাম এর চেয়ে বেশি হয়ে যেত।’
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর যশোরের সহকারী পরিচালক ওয়ালিদ বিন হাবিবের কাছে জানতে ফোন করলেও তিনি তা রিসিভ করেননি।