
মৃত্যু মানে একবারে পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নেয়া আর ধর্ষণ হলো সেই মৃত্যু যন্ত্রণাকেই দীর্ঘায়িত করা। বলতে হয় যমরাজ যেন তারিয়ে তারিয়ে এই মৃত্যুকে উপভোগ করে। কথাটা এভাবে বললে ব্যাঙ্গাত্বক শোনায় কিন্তু যার সাথে এমন ঘটে তার জন্য ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর অপেক্ষায় বেঁচে থাকা বা মৃত্যুর সাথে সহবাস করার মতোই। সমাজের মানুষেরও হয়তো বিষয়টা গাসওয়া হয়ে গেছে বা আমার সাথে তো ঘটছে না বলে পাশ কাটিয়ে যেতে পারে। তা না হলে মানুষের সমাজে ধর্ষণ মহামারী আকারে পৌঁছায় কি করে! ধর্ষিতা নারীর মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখায় বলে সারাজীবনে কোন অবস্থায় এই গ্লানি সে মন থেকে মুছে ফেলতে পারে না। একবার ভেবে দেখুন তো যে মেয়েটি ধর্ষিত হয়, সে নিশ্চয়ই চেষ্টা করে নিজেকে বাঁচানোর, সেই মুহূর্তে তার এবং তার পরিবারের কাছে দেশ মানে কি! দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, আইন, মহান গনতন্ত্র, উন্নয়ন এসবের মানে কি! ধর্ম- কর্ম, বিধাতা- সৃষ্টিকর্তা, ইহকাল- পরকালের বোধ তার থাকে কি? কারণ জন্ম থেকে শোনা এইসব গালভরা বুলি তার জীবনকে ধারণের মত সুযোগ টুকু দিতে ব্যর্থ হয়। একবার ভাবুন তো-- ধর্ষক কোথায় তৈরি হয়! কোন কারখানায় তো নিশ্চয়ই নয়। আমাদের ঘরেই মা ভাই বোনের সাথে বড় হয়ে ওঠা মানুষ নারীকে অসম্মান করে কেমন করে! আমাদের চারপাশের পরিবেশ থেকেই সে শেখে নারী পুরুষের পার্থক্য। পরিবারের ভিতরেই সে দেখতে দেখতে বড় হয় নারীরা অধস্তন, তার সমকক্ষ বা সমঅধিকারের ভাগিদার নয়। তাদের অবহেলা করা যায়, সর্বপরি নারী ভোগের বস্তু। হয়তো তার পরিবারেই সে দেখতে পায় বাবা তার মাকে সম্মান করে না, মাকে যা খুশি তাই বলা যায়। ঘরের গন্ডি পেরিয়ে বাইরে এসে দেখতে পায় বন্ধুরা মেয়েদের নিয়ে নানান রকম কটুক্তি করে যা ঐ বয়সে খুব স্বাভাবিক ভাবেই ভালো লাগতে থাকে। এটা যে অনুচিত কাজ বা অন্যায় এই বোধটাই ওদের তৈরি হয় না। ইলেকট্রনিকস টেকনোলজির যুগে খুব সহজেই তাদের হাতে মোবাইল ফোন, অবাধ নেটওয়ার্ক, আকর্ষণীয় পর্ণগ্রাফি ইত্যাদির কারণে খুব সহজেই তারা বুঝে যায় নারী একটি শরীরি বস্তু, যা ভোগ করা যায়। এই মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশে বড় হওয়া কিশোর, যুবক বা যে কোন বয়সের মানুষের পক্ষেই নারীকে অসম্মান করা সহজ। তাদের কাছে নারীর পিরিয়ড হওয়া, গর্ভবতী নারীর শারীরিক পরিবর্তন হাস্যরস- কটুক্তির বিষয়। মোট কথা নারীর শরীর মানেই একধরনের যৌন চাহিদা উদ্রেকের বিষয়। ধর্ষকের বিচার হওয়া যেমন অত্যন্ত জরুরী, ধর্ষক যেন তৈরি না হয় সেই বিষয়ে সুদূর প্রসারি চিন্তার ফলপ্রসু প্রস্তুতি নেয়া আরো বেশি প্রয়োজন। আজকাল অধিকাংশ পরিবারে মেয়েদের ছোট থেকেই আত্মরক্ষার জন্য হিজাব, বোরকা পরিয়ে বাইরে পাঠানো হচ্ছে, তাতেও কিন্তু একশ্রেণির মানুষের লোলুপ দৃষ্টি এড়ানো যাচ্ছে না। কারণ বিষয়টি মনস্তাত্ত্বিক। ভিতর থেকে ঠিক না হলে যত বস্তা কাপড়ই গায়ে জড়ানো হোক না কেন ধর্ষকের চোখ তা ভেদ করবেই। তাই নারীকে শুধু আড়াল করা নয় তাকে মানসিক ভাবেও ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন করে গড়ে তুলতে হবে। পাশাপাশি ছেলেকেও শিশু বয়স থেকেই যদি নারী- পুরুষ উভয়ের প্রতিই সমান শ্রদ্ধাবোধ শেখানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নারী শরীরের পরিবর্তন গুলো মানব সৃষ্টির কল্যাণে অতএব নারীর দুর্বলতর সময়ে তার পাশে সহযোগী হিসেবে দাঁড়ানো অবশ্য কর্তব্য। অর্থাৎ ছোট বেলা থেকেই প্রথমে পরিবার তারপর প্রাথমিক থেকে পরবর্তী শিক্ষা কাঠামোর মধ্যে যদি এই বোধ ঢুকিয়ে দেয়া যায় তবেই ধীরে ধীরে আমরা একটি ধর্ষণ মুক্ত সমাজ পেতে পারি। আরো একটা বিষয় একেবারে অভিজ্ঞতা থেকে লেখা- গ্রামে, পাড়ায়, মহল্লায় কিশোর বা উঠতি বয়সের ছেলেরা স্কুল কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের আসা যাওয়ার পথে হাসি বা ইয়ার্কির ছলে নানান রকম কটুক্তি করে, যা অনেক সময় বড়দের চোখে পড়লেও হালকা ভাবে হেসে উড়িয়ে দেন, গুরুত্ব দিয়ে কিছুই বলেন না। অথচ এটা বড় অপরাধের সূচনা লগ্ন। শুরুতেই অপরাধের লাগাম না টানলে পরবর্তী অপরাধের দায় আমাদের সবার উপরেই বর্তাবে। আমাদের মনে আছে জনসংখ্যার চাপ কমাতে আশি নব্বই এর দশকে কিভাবে জন্ম নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির বিজ্ঞাপন সম্প্রচার করা হতো। ডায়রিয়া প্রতিরোধে যেমন হাত ধোয়া কর্মসূচী বিভিন্ন মিডিয়ায় সারাক্ষণ সম্প্রচার হতো বা বর্তমানে করোনা নিয়েও যেভাবে প্রচার হচ্ছে ঠিক তেমনি প্রতিটি পরিবারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মানুষ হয়ে ওঠার প্রশিক্ষণ ও প্রচার করতে হবে। ব্যাপক ভাবে পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন প্রতিটি মহল্লায়। সেই সাথে ধর্ষণ এবং নারীর প্রতি সকল প্রকার অনাচার প্রতিরোধে এইসব অপরাধের অতি দ্রুত বিচার এবং শাস্তির ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের সন্তানরা যেন অমানুষ, পাষণ্ড না হয়, ধর্ষক হয়ে না ওঠে, নারীকে শরীর না ভেবে মানুষ ভাবতে শেখে সে ব্যাপারে এখনি আমাদের ব্যবস্থা নেয়া বা সচেতন হওয়া এখন সময়ের দাবি।