
গণমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই আসছে নারীর প্রতি নৃশংসতার একাধিক খবর। বাদ যাচ্ছেনা অবুঝ শিশু, প্রতিবন্ধী থেকে বাহাত্তোরোর্ধ নারীও। ধর্ষণ কিংবা গণধর্ষণই শেষ নয়, ধর্ষণের পর খুন করা হচ্ছে নৃশংসভাবে। দেশে ধর্ষণ ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। পরিস্থিতি এতটাই সর্বব্যাপী যে, সমাজের প্রায় প্রতিটি স্তরে নারীরা রয়েছেন নিরাপত্তাহীনতায়।
‘ডয়চে ভেলে বাংলা’ জার্মানির প্রধান বেতার সার্ভিসের বাংলাভাষার অনুষ্ঠান। এই বেতার সার্ভিসকে বলা হয় ইউরোপের হৃদয়। অনুষ্ঠানে জার্মানি, ইউরোপ-সহ বিশ্বের খবরাখবর পরিবেশন করা হয়। নোয়াখালীর জয়কৃষ্ণপুর গ্রামে এক নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ঘটনা সম্পর্কে ডয়চে ভেলের উন্মুক্ত ফেসবুক পাতায় কয়েকজন পাঠক কিছু প্রতিক্রিয়া লিখেছেন। জনৈক খন্দকার নাসিমা নওশাদ লিখেছেন, ‘‘শুধু নোয়াখালী নয়, পুরো দেশই এখন সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। যতবার ভিডিওটা দেখেছি, ততবারই চিৎকার দিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করেছে। আল্লাহর কাছে আশ্রয় চেয়েছি।’’ একজন লিখেছেন, ‘‘এই সামাজিক অবক্ষয়ের শেষ কোথায়? দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। আর যদি সম্ভব হয় এই অমানুষগুলোকে প্রকাশ্যে ক্রসফায়ার দেওয়া হোক।’’ পাঠক জাহাঙ্গীর আলমের মন্তব্য, ‘‘এরকম দু-একটা ঘটনা হয়তো মিডিয়াতে প্রকাশ পাচ্ছে, কিন্তু বাস্তবতা আরো ভয়াবহ।’’ শাহাব হাওলাদার লিখেছেন, ‘‘প্রশাসনের প্রত্যক্ষ মদদে সন্ত্রাসীরা এ ধরনের অপরাধের রাজত্ব কায়েম করেছে। বেগমগঞ্জের ঘটনায় কেউ পুলিশে অভিযোগ করেনি, ভিডিও প্রকাশের পর পুলিশ তৎপর হয়েছে’। একজন লিখেছেন, অভিযোগ কেন করবে, কার কাছে করবে? অপরাধকারী সবাই নিজেরা নিজেরাই, কার বিচার কে করবে?’’
বাস্তবতাটা হচ্ছে, লোকলজ্জার ভয়ে হাজারো নৃশংসতার খবর মিডিয়ায় আসছে না, আবার থানা-পুলিশ করছেন না অনেকে। যে কারণে আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়া শিশু ও নারীর প্রতি পাশবিকতা, নৃশংসতার প্রকৃত পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছেনা।
এই নৃশংসতা এখন নিরাপদ ঘরের মধ্যেও হচ্ছে। মা-মেয়ে সেখানে এক সাথে ধর্ষিত হচ্ছেন। মাদ্রাসায় ধর্ষিত হচ্ছেন। কলেজে ধর্ষিত হচ্ছেন। বাসে ধর্ষিত হচ্ছেন। মিডিয়ার আড়াল হলেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে অপরাধ করে পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা। তাতে অপরাধ করার প্রবণতা আরও বাড়ছে। দেখা গেছে, ধর্ষণের অনেক ঘটনায় সামাজিক সম্মানের কারণে এবং বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ভুক্তভোগীরা এ বিচারমুখী হচ্ছেন না। এখনি যদি এই ভয়াবহতার রেশ টেনে ধরা না যায়, তাহলে ভবিষ্যতে এর পরিণতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা ভেবে কুল পাচ্ছেন না অভিভাবক মহল ও অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। বিষয়টি এমন পর্যায়েও গেছে যে, মানুষ গড়ার কারিগর পিতৃতুল্য শিক্ষকের কাছেও নিরাপধ নয়, সন্তানতুল্য মেয়েরা। কতটুকু নৈতিক অবক্ষয় হলে আজ দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষককের কাছেও ছাত্রীরা নিরাপদ বোধ করছে না। এই নৈতিক অবক্ষয়ের শেষ কোথায়?
কুষ্টিয়ায় আলোচিত স্কুল শিক্ষক হেলাল উদ্দিন ওরফে পান্না মাস্টার, ভিকারুননেসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের পরিমল, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুলের ইংরেজি ভার্সনের হুমায়ুন কবির, নারায়ণগঞ্জের লম্পট আরিফুল ইসলাম। যে পাঁচ বছরে পঞ্চম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির অন্তত ২০ শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করেছে। শুধু শিক্ষার্থীকে ধর্ষণ করে ক্ষান্ত হয়নি, ফাঁদে ফেলে শিক্ষার্থীর মাকেও ধর্ষণ করেছে। লম্পট এই শিক্ষকরা কখনো পরীক্ষায় কম নম্বর দেওয়া বা ফেল করিয়ে দেওয়ার ভয় দেখানো। আবার কখনো ছাত্রীদের বিভিন্নভাবে ব্ল্যাকমেল করে এসব কুকর্ম করে আসছে। শতাধিক ছাত্রীকে ধর্ষণ এবং পর্নোগ্রাফি মামলায় পান্না মাস্টারকে মাত্র ১০ বছর কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত। এ ধরনের একটি ভয়ংকর অনৈতিক কর্মকান্ড করেও যখন অপরাধী লঘু শাস্তি পায়, তখন অনায়েশে মানুষের মাঝে অপরাধ করার দূ:সাহস বৃদ্ধি পায়। নানা ধরনের প্রভাব ও রাজনৈতিক অপ্রত্যাশিত প্রশ্রয়ের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই বিচার পাওয়া যায় না। বিচার পেতে অপেক্ষা করতে হয় যুগের পর যুগ। রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে শান্তি-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে অপরাধের দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করার প্রয়োজন এখন সময়ের দাবী।
আধুনিক যুগে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অভ্যন্তরে শাস্তির যে বিধান প্রচলিত তা প্রতিশোধমূলক; প্রতিরোধমূলক; ও সংশোধনমূলক। এ তিনটির সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে আধুনিক শাস্তিতত্ত্ব ও বিধান। প্রতিরোধমূলক শাস্তিতত্ত্বের মূল কথা হলো অপরাধের শাস্তির মাধ্যমে তার পুনরাবৃত্তি না হওয়া নিশ্চিত করা। মধ্যযুগে এ তত্ত্বের ভিত্তিতে অপরাধীর শাস্তি হিসেবে তার হাত অথবা পা কর্তন কিংবা পঙ্গু করার বিধান ছিল।
বর্তমান সময়ে দেশের চলমান নৃশংসতার ঘটনায় প্রতিরোধমূলক শাস্তি বিধান রেখে সামাজিকভাবে প্রতিরোধ করার বিষয়টি ভাবা হচ্ছে। প্রতিরোধমূলক শাস্তিতত্ত্ব নিয়ে প্রচলিত একটি গল্পে বিচারক বলছেন, ‘আমি তোমাকে ভেড়াটি চুরি করার জন্যে শাস্তি দিচ্ছি না। আমি তোমাকে শাস্তি দিচ্ছি, যেন মানুষ ভবিষ্যতে ভেড়া চুরি না করে।’ শাস্তির মাধ্যমে এটি নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রের মূল দায়িত্ব। আর তাই যেকোনো ধরনের শাস্তির মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত ন্যায়, শান্তি, সামাজিক স্থিতি রক্ষা করা ও অপরাধীর অপরাধ করার মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো।
আমাদের দেশে অনেক আগে থেকেই বিচারহীনতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। অনেক দেশে কিন্তু দ্রুত বিচার আইনে সাজা হয় এবং মানুষ তা দেখে সচেতন হয়। কিন্তু আমাদের দেশে সেটা হয় খুবই ধীরগতিতে। ফলে অপরাধীরা পার পেয়ে যায়। অনেক ক্ষেত্রে দেশত্যাগ করে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে চলে যায়।
আমরা ক্রমেই এক নিষ্ঠুর সময়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি যেখানে মানবিকতা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ, দয়া, মমতা এসব শব্দের কোনো অস্তিত্বই নেই! তার জায়গা দখল করে নিয়েছে অনৈতিকতা, অমানবিকতা, নিষ্ঠুরতা, স্বার্থপরতা, জিঘাংসা, হিংসা, বিদ্বেষ কিংবা এ জাতীয় সব নেতিবাচক শব্দের কালো হাত। প্রতিদিনের খবরের কাগজে এমন অনেক খবর আসে, যা দেখলে যে কোনো সভ্য মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হয়। ধর্ষিতা শিশুকন্যার অসহায় বাবা মেয়েকে নিয়ে ট্রেনের তলায় আত্মাহুতি আর কত?
বর্তমান সময়ে সামাজিক অপরাধগুলোর মাত্রা অতিক্রম করতে চলেছে। এ অবস্থায় এখনই লাগাম টেনে ধরা না গেলে আগামীতে ভয়াবহ রূপ নেবে সামাজিক অপরাধ। দেশে ভয়াবহ ব্যাধির মতো দানা বাঁধছে সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়। আর নীতিনির্ধারক মহলের অবহেলা আর নজরদারির অভাবে সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার ব্যক্তিদের প্রাণহানির ঘটনা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। অর্থের প্রতি অতি লালসা, শ্রেণি-পেশা নির্বিশেষ সব মানুষের অসম প্রতিযোগিতা, নৈতিক মূল্যবোধের অভাব, সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক অস্থিরতা, অন্য দেশের সংস্কৃতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা, দাম্পত্য কলহ ও স্বামী-স্ত্রীর প্রতি বিশ্বাসহীনতা, সামাজিক উন্নয়নে পদক্ষেপ না নেয়া, ব্যক্তি বিষন্নতা ও মাদকাসক্তি, রাষ্ট্রের উদাসীনতা ইত্যাদি।
সর্বগ্রাসী সামাজিক অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি। ইতিহাস বলে, সব কাল একভাবে যায় না। কোনো কোনো কাল আসে যখন আপাত উন্নতি ও বৈভবের নিচে মনুষ্যত্বের কঙ্কাল তৈরি হয়। সেটা সময়মতো বোঝা যায় না, বাহ্য চাকচিক্যে মোহগ্রস্ত মানুষ বিবেকের হাহাকার ও কাতরোক্তি শুনতে পায় না। বিবেক হারালে ধনী হোক, জ্ঞানী হোক, সে তো আর মানুষ থাকে না। জাতিও কি তবে মানুষের জাতি থাকে?
বর্তমান সময়ে আমাদের পরিবারগুলোতে বিবেক বা নৈতিক শিক্ষার চর্চা কতটা হয়? দৈনন্দিন জীবনের বিভিন্ন সম্পর্ক সূত্রে ও কর্মকান্ডে নৈতিক মূল্যবোধ কতটা রক্ষিত হয়? এছাড়া পরিবারের সদস্যরা পরস্পরের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে কতটা সতর্ক? পরিবার তো শুধু খাওয়া ও শোয়ার জায়গা নয়, এর চেয়ে আরো বেশি কিছু। এ বিষয়ে সচেতনতার অভাবে পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বাড়তে থাকে অভিযোগের মাত্রা। এখান থেকেই উৎপত্তি হয় ক্ষোভ, বিষন্নতা, বিশ্বাসহীনতা। পরিবারের সদস্যরাই সমাজে ছড়িয়ে পড়ে এবং সেখানে তাদের মানসিকতা ও কর্মকান্ডের প্রতিফলন ঘটে। চারদিকে যে সামাজিক অবক্ষয় ও তারুণ্যের অবক্ষয় চলছে তার কি কোনো প্রতিষেধক নেই? আমরা কি সমাজকে কখনোই কলুষমুক্ত করতে পারব না? নিশ্চয়ই পারব। তবে তার জন্য যারা সমাজকে কলুষিত করছে, সমাজের মানুষের নিরাপত্তা ও অধিকার ক্ষুন্ন করছে তাদের বিরুদ্ধে আমাদের রুখে দাঁড়াতে হবে। যে করেই হোক সামাজিক সুস্থতা ফিরিয়ে আনতে হবে।
এই সর্বগ্রাসী সামাজিক অবক্ষয়ের হাত থেকে বাঁচতে হলে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সামাজিক সচেতনতা সৃষ্টি। যার শুরুটা হতে হবে গৃহাভ্যন্তর থেকেই। এটা সবারই মনে রাখা উচিত যে, সামাজিক সমস্যা দূর করতে রাষ্ট্রের সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে; কিন্তু মূল দায়িত্বটি কিন্তু পরিবারকেই নিতে হবে। আত্মশুদ্ধির চর্চা ও নৈতিক শিক্ষা গ্রহণ করে একজন আদর্শবান নাগরিক ও সত্যিকারের মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারলেই অবক্ষয়ের বহুমুখী ব্যাধি থেকে সমাজ ও জাতিকে রক্ষা করা সম্ভব হবে।
শুধুমাত্র ধর্ষকের শাস্তি মৃতুদন্ড হলেই ধর্ষণ উধাও হবেনা। হত্যারও শাস্তি মৃতুদন্ড আছে কিন্তু হত্যাকান্ড থেমে নেই, বন্ধ হয়ে যায়নি। এই বিষয়ে যত অ্যাকাডেমিক লিটারেচার আছে তাতে দেখা যায় যে, ‘রিঅফেন্ডিং রেট’ অর্থাৎ শাস্তির পরও আবার অপরাধ করার যে প্রবণতা সেটা কোনো দেশে কমানো যায় নি। অপরাধীর মনে ভীতি জাগিয়ে তোলার হাতিয়ার হিসেবে অনেক দেশে মৃতুদন্ড প্রতিষ্ঠিত একটি শাস্তি। মৃতুদন্ড দিয়ে অপরাধীকে নির্মূল করা যায় কিন্তু অপরাধ নির্মূলের জন্য কোনো কার্যকরী ব্যবস্থা সমাজ ব্যবস্থায় না থাকলে শুধুমাত্র অপরাধীকে ধরে মৃতুদন্ড দিলেও অপরাধটা কিন্তু থেকেই যায়। ধর্ষকের মৃতুদন্ডের নতুন আইনের ফলে সমাজে অবশ্যই একটা মেসেজ যাবে সন্দেহ নেই, তবে অপরাধ কমানোর টেকসই ব্যবস্থা নির্মাণে বিবেক-বিবেচনা বৃদ্ধির জন্য পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রের সমন্বিত জোরালো উদ্দ্যোগ এবং পক্ষপাতহীন কঠোর আইনের শাসনের সত্যিই কোনো বিকল্প নেই।
লেখক ও সমাজ কর্মী
(০১৭১১-৮৭৭০৮৭ শুধুমাত্র এসএমএস)