
হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব দূর্গাপূজা। মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে শুরু এ উৎসবের দ্বিতীয় দিন মহাসপ্তমী আজ। দেশের প্রতিটি শহর, বাজার, গ্রাম ও পাড়া-মহল্লায় পূজার আয়োজন করা হয়েছে। প্রায় দু’শ’ বছর পূর্বেও যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার জহুরপুর গ্রামেও এর ব্যতিক্রম ছিল না। আয়োজন করা হয়েছিল দূর্গাপূজার। ঠিক সেই সময়ে গ্রামে এক বড় ধরনের মহামারি আসে। তখন থেকেই বন্ধ হয়ে যায় এখানকার পূজা। কুসংস্কারের সেই বেড়াজাল ভেঙে দু’শ’ বছর পর এ বছর সেখানে দুর্গোৎসব হচ্ছে। গ্রামের একদল স্বপ্নবাজ তরুণ যুবক এর আয়োজন করেছে।
ষষ্ঠীর দিন বৃহস্পতিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বাঘারপাড়া-কালীগঞ্জ মহাসড়কের জহুরপুর বাজারের প্রবেশমুখে বামে গ্রামের রাস্তার শুরুতেই বিশাল এক তোরণ। সামনে প্রায় তিনশ’ ফুট পর্যন্ত রাস্তা মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো। এর পরেই জহুরপুর সার্বজনীন মন্দির প্রাঙ্গণে সুসজ্জিত দূর্গাপূজার মন্ডপ। সিসি ক্যামেরাদ্বারা নিয়ন্ত্রিত এ মন্ডপে স্বাস্থ্যবিধি মানতে প্রবেশমুখে রাখা হয়েছে সাবান-পানি। নারী-পুরুষের জন্যে যাতায়াতে রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা। সামাজিক দূরত্ব ঠিক রাখতে মন্ডপের ভেতরে তিন ফুট দূরত্বে অনেকগুলো সাদা রঙের বৃত্ত রয়েছে। এর মধ্যেই প্রতিজন ভক্ত ও দর্শনার্থীর দাঁড়াবেন। এখানে সর্বক্ষণিক নিরাপত্তা বজায় রাখতে পুলিশ, গ্রাম পুলিশ, আনসার সদস্যসহ রয়েছে নিজস্ব সেচ্ছাসেবক। নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত প্রতিজন ভক্ত ও দর্শনার্থী মন্ডপের ভেতরে থাকতে পারবেন। এক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক সবার মুখে মাস্ক রাখতে হবে বলে জানান আয়োজক কমিটি।
দূর্গাপূজা বন্ধের সেই ইতিহাস জানতে কথা হয় গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে। আশি বছর বয়সী হাজারী বিশ্বাস, মন্দিরের পূজারিনী কল্পনা বিশ্বাস, পঁচাত্তর বছর বয়সী অনাথ সরকার জানান, তারা কখনো গ্রামে দূর্গাপূজা দেখেননি। কিন্তু বংশ পরম্পরায় শুনেছেন প্রায় দু’শ’ বছর পূর্বে গ্রামে পূজার আয়োজন করা হয়েছিল। ঠিক সে সময়ই গ্রামজুড়ে কলেরা (ডায়রিয়া) মহামারি আসে। এতে অনেক লোক মারা যায়। সে বছর থেকেই এখানকার দূর্গাপূজার আয়োজন বন্ধ হয়ে যায়।
তারা আরও জানান, পূর্ব পুরুষদের ধর্মীয় বিশ্বাস ছিল মা দূর্গা কোনো কারণে অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন। যে কারণে ওই মহামারিটি আসে। সেই বিশ্বাস মতে তারা এর আগে কখনো পূজার আয়োজন করেননি।
জহুরপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ওই গ্রামের সন্তান তাপস কুমার ও পল্লী চিকিৎসক উত্তম বিশ্বাস জানান, ৩০ বছর পূর্বে একবার দূর্গাপূজা উদযাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সে বছর বিরূপ আবহাওয়ার কারণে তা পন্ড হয়ে যায়।
দুর্গোৎসব আয়োজক কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন বিশ্বাস জানান, ‘সম্প্রতি যশোর সরকারি এমএম কলেজ থেকে গণিতে মাস্টার্স শেষ করেছি। করোনার কারণে এ বছর দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ায় লম্বা ছুটি পেয়েছি। তাই পূজার আগে গ্রামে এসে সমবয়সী ও ছোটদের নিয়ে এবার দূর্গাপূজার আয়োজন করেছি’।
কমিটির সভাপতি সরকারি চাকুরে সীমান্ত সরকার বিশ্বাস জানান, ‘প্রায় দু’শ’ বছর ধরে গ্রামের মানুষ কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিলেন। মা দুর্গার আগমন কখনো অশুভ হয় না। তার প্রমাণ এ বছর গ্রামে আয়োজিত দুর্গোৎসব। এবার মায়ের আগমণে সকল অন্ধকার ও দুঃখ-কষ্ট ঘুচে যাবে। কনোনারূপী অসুর বিনাশ হবে’।
জহুরপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দীন মোহাম্মদ দীলু পাটোয়ারী জানান, ‘ইউনিয়নে ছয়টি স্থানে দূর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। কয়েক যুগের ধর্মীয় এক কুসংস্কারকে ভেঙে সেখানে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হওয়ায় তা সকলের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে’।
বাঘারপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানিয়া আফরোজ জানান, ‘শান্তিপূর্ণভাবে এ উৎসব শেষ করতে ইতিমধ্যে তিন স্তরের আইন শৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে’।