
ধর্ম যার যার, উৎসব সবার। বাঙালি সংস্কৃতির মূল চেতনার জায়গা বোধ হয় এখান থেকেই সূচনা হয়। বাংলা ভাষাভাষি মানুষের চেতনা, কৃষ্টি, সকল ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষ মিলেমিশে যাপিত জীবনের কর্মধারাই বাঙালি সংস্কৃতি। এই ধারায় এসে মিশেছে প্রাতিষ্ঠানিক বা অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা, শিল্প চর্চা, পরমতসহিষ্ণু ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং বিভিন্ন আচার- অনুষ্ঠান। বাঙালি সংস্কৃতিতে যেমন আছে বিভিন্ন ধর্মীয় উৎসব তেমনি জড়িয়ে আছে অসংখ্য লোকজ সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারা।
ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে যেমন মুসলিম স¤প্রদায়ের ঈদুল ফিতর, ঈদুল আজহা, মহরম, শবেবরাত, তেমন রয়েছে হিন্দু স¤প্রদায়ের দুর্গা পূজার মহোৎসব, কালি পূজা, স্বরস্বতী পূজা, চৈত্র সংক্রান্তি। রয়েছে খ্রিস্টান ধর্মীয় বড়দিন, বৌদ্ধ পূর্ণিমা, প্রবারণা পূর্ণিমা। এছাড়াও রয়েছে অসংখ্য ছোট বড় আচার অনুষ্ঠান, আদিবাসী, নৃগোষ্ঠির নিজস্ব সংস্কৃতির অনুষ্ঠান। এই সকল ধর্মের অনুষ্ঠান তখনই বাঙালি সংস্কৃতির অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে যখন সব ধর্মের মানুষ সকল ধর্মীয় উৎসবের সাথে একাত্বতা গ্রহণ করে।
ধর্মীয় উৎসবের বাইরেও বাংলাদেশে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির বিভিন্ন ধারা। লোকজ এইসব উৎসবই বাঙালি মেলবন্ধনকে একাত্ম করে রেখেছে চিরকাল। তার ভিতর রয়েছে পয়লা বৈশাখ, যা সারা দেশ ব্যাপি সকল ধর্ম বর্ণ শ্রেণি-পেশার মানুষের মিলনমেলা হিসেবে পরিচিত। এছাড়াও আছে বিভিন্ন ঋতু ভিত্তিক উৎসব, নবান্ন, পৌষমেলা সহ নানান ধরনের অনুষ্ঠান।
একসময় বাংলাদেশের গ্রাম গঞ্জের আনাচকানাচে ছড়িয়ে ছিল ছোট ছোট নানান ধরনের লোকজ উৎসব। যার মধ্যে ছিল পালাগান, কবিগান, ঘেঁটু গান, ভাব গান, যাত্রা পালা। ঘরে ঘরে বা পাড়ায় পাড়ায় চলতো পুথি পাঠের আসর। সারাদিন পরিশ্রমের ক্লান্তি ভুলে মানুষের নিরবিচ্ছিন্ন বিনোদনের উপকরণ ছিল এইসব সাংস্কৃতিক উৎসব বা অনুষ্ঠান। বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলাও ছিল বাঙালি সংস্কৃতির অংশ। ফুটবলের সাথে পাল্লা দিয়ে হাডুডু, নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা হতো গ্রামে গ্রামে। ছোটদের জন্যও ছিল নানান ধরনের খেলা। বউচি, দাড়িয়াবান্ধা, গাদি, গোল্লাছুট, কানামাছি আরো কত কি নিয়ে মেতে থাকতো বাঙালির শৈশব কৈশোর।
বর্তমান সময়ে বাঙালি সংস্কৃতির একটা বড়ো অংশ বিদেশি অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে বিলুপ্ত প্রায়। তার উপর অবশিষ্ট যে কয়টি বড়ো বড়ো উৎসব এখনো স্বগর্বে মাথা তুলে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে অতি স¤প্রতি বিশ্ব ব্যাপি মহামারী আকারে কোভিড উনিশ করোনা ভাইরাস এর আক্রমণে তা নিষ্প্রভ হতে বসেছে। এবছর পয়লা বৈশাখ পালন করা যায়নি। দুই ঈদ উৎসবও দায়সারা ভাবে পালিত হয়েছে। এখন চলছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও বড়ো উৎসব শারদীয় দুর্গা পূজা। মহালয়া থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত ষোল আনা- বাঙালিআনা ধাঁচে প্রতিটি বাঙালির ঘরে লাগে যে উৎসবের ছোঁয়া। এবছর কোভিড উনিশ এর সংক্রমণের ভয়ে সারাদেশে বারোয়ারী এই দুর্গোৎসব নানান বিধিনিষেধের মধ্য দিয়ে সীমিত পরিসরে পালন করতে হচ্ছে। পূজা মন্ডপের সংখ্যা কমেছে, সীমিত হয়েছে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান এর নিয়ম কানুন। মানুষের মনে সেই আনন্দ উৎসবের রেশ যেন ¤øান হয়ে গেছে। অচিরেই পৃথিবী এই প্রাণঘাতী মহামারীর কবল থেকে মুক্ত হোক, ফিরে আসুক বাঙালির উৎসব মুখর দিনগুলি এমনটাই প্রার্থনা এখন দেশবাসীর।
পরিশেষে শুধু এটুকু বলি, বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির যে ধারাগুলো বিলুপ্তির পথে সেগুলোকে যদি আমরা সঠিক নিয়মে আবার ফিরিয়ে দিতে না পারি অপসংস্কৃতির ছোবল থেকে আমাদের মুক্তি নেই। বিদেশি বা আধুনিক সংস্কৃতিকে আমরা অবশ্যই গ্রহণ করবো, ব্যবহার করবো কিন্তু তা অবশ্যই আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির ভিত্তিকে মজবুত রেখে। খুলে দাও বাঙালি সংস্কৃতির বন্ধ দুয়ার, মুক্ত হোক শুদ্ধ সংস্কৃতি সকল অন্ধকার অপসংস্কৃতির কবল থেকে। এমনটাই আশা করি সুস্থ সমাজের স্বপ্নদ্রষ্টাদের কাছ থেকে। শুভ শারদীয়া শুভেচ্ছা সবাইকে।