
একটা বন্ধ দরজা। অপু সেটা খুলে দিয়ে অপর্ণাকে বলবে, “এসো।” ক্যামেরা নিয়ে পরিচালক সহ পুরো ইউনিট। সেই মুহূর্তেই অপু অপর্ণাকে বলে উঠল “নার্ভাস লাগছে? উত্তরে তিনি বললেন, “নাহ্।” অপুর প্রয়াণের পর অপুর সংসার সিনেমা নিয়েই সৌমিত্রকে নিয়ে কলম ধরলেন বিখ্যাত ভারতীয় অভিনেত্রী ও পরিচালক অপর্ণা সেন। সৌমিত্রের সাথে অপর্ণারও এই অপুর সংসার সিনেমার মাধ্যমেই অভিষেক হয়েছিল চলচ্চিত্র অঙ্গনে।
অপর্ণা বলেন, কখনও মনে হয়নি, আমি একটা বড় ছবিতে অভিনয় করছি। মনে হয়নি, ছবির পরিচালক এক বিরাট মাপের মানুষ। আর আমার পাশে দাঁড়ানো নায়ক মানুষটিও আমার চাইতে ১০ বছরের বড়। অপুর সংসার সিনেমা থেকেই প্রথম সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আলাপ।
ওই সিনেমার কিছু শট চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। যেমন বিয়ের পর ফুলশয্যার রাতে অপু আর অপর্ণা। ব্যাকগ্রাউণ্ডে মাঝির ভাটিয়ালি গানের সুর। খাটের এক পাশে অপর্ণা দাঁড়িয়ে। অপু তাকে নিজের কথা বলছে। অথবা সকালে ঘুম থেকে ওঠার দৃশ্য। অপুর চাদরে অপর্ণার আঁচল বাঁধা। অপু ঘুম ভেঙে শুয়ে রয়েছে। হাতে অপর্ণার চুলের কাঁটা। দূরে অপর্ণা উনুন ধরাচ্ছে। কিম্বা অপর্ণা চুল বাঁধছে। অপু চৌকাঠে বসে। অপু অপর্ণাকে জিজ্ঞাসা করছে, ‘‘তোমার অনুশোচনা হয় না?’’ অপর্ণা বলছে, সে অত শক্ত কথা বুঝতে পারে না। অপু বলছে, ‘‘আফসোস হয় না?’’ অপর্ণা ইয়ার্কি মেরে বলছে, ‘‘হয়।
বড়লোকের বাড়িতে বিয়ে হলে পায়ের উপর পা তুলে বসে থাকা যেত।’’ সেই সিনেমায় ওই শটগুলোর মধ্য দিয়ে নিজেদের আলাপ শুরু বলে জানালেন অপর্ণা সেন। তিনি বলেন, বয়সের পার্থক্য থাকলেও সৌমিত্রর সঙ্গে আমার বন্ধুত্বে কোনও কিছুই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। অনেকগুলো সিনেমায় তো করেছি ওর সঙ্গে। ‘অপুর সংসার’, ‘দেবী’, ‘কিনু গোয়ালার গলি’, ‘বর্ণালী’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘আবার অরণ্যে’।
অপর্ণার ভাষায় সৌমিত্রর সঙ্গে আমার প্রথম ছবির শটের মুহূর্তটাই কেমন যেন প্রতীকী বলে মনে হয়। একটা দরজা খুলে আমাকে নায়ক বলছেন, “এসো।” শুরু হচ্ছে আমার স্ক্রিন কেরিয়ার। আর শুরু হচ্ছে এমন একটা মানুষের সঙ্গে বন্ধুত্ব, যিনি একই সঙ্গে অভিনেতা, লেখক, কবি, চিত্রকর, সঙ্গীতশিল্পী, আবৃত্তিকার। ফুটবল থেকে কবিতা, ক্রিকেট থেকে গিরিশ ঘোষ, যে কোনও বিষয় নিয়ে কথা বলতে পারেন, এমন মানুষের দেখা কমই পেয়েছি। আমাদের যে খুব নিয়মিত যোগাযোগ ছিল এমন নয়। কিন্তু যখনই কথা হয়েছে, প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গে গড়িয়ে গিয়েছে আড্ডা। কারণ, সৌমিত্র ছিলেন সেই বিরল এক মানুষ, যিনি যে কোনও সময়ে যে কোনও বিষয়ে অনর্গল কথা বলে যেতে পারতেন।