
শোকাবহ ১৯ নভেম্বর। আপন সহোদরসহ তিন বীর সেনানীর আত্মোৎসর্গের দিন। একাত্তরের রণাঙ্গণে এই দিনে পাকিস্তানি দোসরদের সাথে মুক্তিকামী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তুমুল যুদ্ধ হয়। সে যুদ্ধে পাকিস্তানি দোসরদের ছোড়া গুলিতে দু’সহোদর আহম্মদ ও মহম্মদ শাহাদৎ বরণ করেন। এই যুদ্ধে যশোরের রূপদিয়া এলাকার মহম্মদ আলী নামের আরও এক বীরযোদ্ধা শহীদ হন। স্বাধীনতার ইতিহাসে দিনটি ঐতিহাসিক এবং বেদনাবিধূর।
১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে পাকিস্তানি সেনারা স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় টিটিডিসি ভবনে (বর্তমান উপজেলা পরিষদ) ক্যাম্প স্থাপন করে উপজেলার বিভিন্ন গ্রামে লুটপাট ও নিরীহ মানুষের ওপর নানা রকম অত্যাচার ও নির্যাতন চালায়। ওই ভবনেই তারা শক্তিশালী পর্যবেক্ষণ চৌকি তৈরি করে। এই ক্যাম্প আক্রমণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন মহম্মদপুরের বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
১৮ নভেম্বর আনুমানিক রাত একটায় উপজেলা সদর থেকে দক্ষিণ পশ্চিমে সাত কিলোমিটার দূরে ঝামা বাজারে সমবেত হন মুক্তিযোদ্ধারা। পরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধা কমল সিদ্দিকী (বীর উত্তম) ও তার বাহিনীর ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা টিটিডিসি ভবনের দক্ষিণে, আবুল খায়ের ও নুর মোস্তফার যৌথবাহিনীর ৫৫ জন মুক্তিযোদ্ধা উত্তর দিকে, বীর প্রতিক গোলাম ইয়াকুব মিয়ার নেতৃত্বে দুশ’জন মুক্তিযোদ্ধা দক্ষিণ-পশ্চিমে এবং আহম্মদ হোসেনের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা উত্তর-পূর্বকোণে অবস্থান করেন। সিদ্ধান্ত ছিল কমল সিদ্দিকীর বাহিনী ও ইয়াকুব হোসেনের বাহিনী আক্রমণ করবে এবং অপর বাহিনী সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। কিন্তু, ঝামা বাজার থেকে মহম্মদপুর আসতে বেশ দেরি হয়ে যাওয়ায় এবং পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ করতে না পারায় ফজরের আযানের মাত্র আধাঘণ্টা আগে পাকিস্তানি সেনাক্যাম্পে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ চালায়। দীর্ঘক্ষণ দু’ পক্ষের মধ্যে গুলিবিনিময় হয়। হানাদার বাহিনীর ব্যাপক গোলাবর্ষণের মুখে এক সময় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেন। এসময় একটি গুলি আহম্মদ হোসেনের মাথায় বিদ্ধ হয়। বড়ভাই মহম্মদ হোসেন ছোট ভাইকে বাঁচাতে ছুটে যাওয়ার প্রাক্কালে তিনিও গুলিবিদ্ধ হন। দু’ভাই পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে গড়াতে গড়াতে পুকুরের পানিতে পড়ে যান এবং সেখানেই তারা শহীদ হন। অল্প সময়ের ব্যাবধানে শহীদ হন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙ্গালি সৈনিক মহম্মদ আলী।
শহীদ সহোদর আহম্মদ ও মহম্মদকে উপজেলার নাগড়িপাড়া গ্রামে পাশাপাশি দাফন করা হয়। তাঁরা ওই গ্রামের আফসার উদ্দিনের ছেলে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের এই বীর শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে মহম্মদপুর সদরে ‘শহীদ আহম্মদ-মহম্মদ মার্কেট’ এবং উপজেলা সদর থেকে নাগড়িপাড়ামুখি যে সড়কটি গিয়েছে তার নামকরণ করা হয়েছে ‘আহম্মদ-মহম্মদ সড়ক’।
দিনটি উপলক্ষে পরিবারের পক্ষ থেকে উপজেলার নাগড়িপাড়া গ্রামে কোরআনখানি, মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।