
কোভিড উনিশ করোনা ভাইরাস দ্বিতীয় পর্বে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাপি লক্ষ লক্ষ জীবন, মানুষের মনোবল, আগামী দিনের স্বপ্ন, ভবিষ্যতের কর্মপরিকল্পনা গুড়িয়ে দিয়ে কিছুদিন যেন রণ-ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। আশা করতে ইচ্ছা করছিল হয়তো এইবার শেষ হবে করোনা ভাইরাস এর বিশ্ব পরিক্রমা। কিন্তু না! পাশ ফিরে আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। সংক্রমণের সংখ্যা, মৃত্যুর হার লাফিয়ে লাফিয়ে আবার বাড়ছে। আমাদের দেশেও প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। গ্রাম পর্যায়ে এই মহামারীর প্রভাব ততটা না ছড়ালেও রাজধানী সহ শহরাঞ্চলে এর প্রকোপ আশঙ্কাজনক। এই এক বছরে কত অসংখ্য মানুষ আমরা হারিয়েছি তার ইয়ত্তা নেই। তার ভিতরে আছেন দেশের বহু বরেণ্য মানুষ, যাঁরা দেশের অত্যন্ত অপরিহার্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন।
প্রতিটি মৃত্যুই বেদনাদায়ক, পরিবারের জন্য অপূরণীয় ক্ষতি। সেই মৃত্যুদূত হয়েই যেন পৃথিবীতে এসেছে করোনা ভাইরাস। আরো কতদিন এমন জীবন-মৃত্যু নিয়ে আশা নিরাশার পেন্ডুলামে দুলতে হবে তা আমাদের বোধের বাইরে। ইদানিং জানতে পারছি করোনা ভাইরাসের ভ্যাকসিন আসছে। বিশ্বের নামীদামী প্রতিষ্ঠানের গবেষণা লব্ধ করোনা ভ্যাকসিন নিয়ে আশাব্যঞ্জক নানা রকম খবরও শোনা যাচ্ছে, কিন্তু সে আমাদের মত সাধারণের নাগালের ভেতরে কবে আসবে বা আদৌ আসবে কিনা তা এখনি অনুমান করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ সচেতনতাই একমাত্র ভরসা আমাদের।
করোনাকালে বিশ্বব্যাপি আরো যে ভঙ্গুরতা সংক্রমিত হয়েছে তা হলো মানুষের স্বপ্ন, মানুষের সম্পর্ক। ছাত্র, অভিভাবক, চাকরিজীবী, সাধারণ শ্রমিক, কর্মজীবী, ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠান, মোট কথা যে যার অবস্থানে থেকে তার আগামী দিনের স্বপ্ন রচনা করে। কিন্তু করোনার আঘাতে সেই স্বপ্ন ভেঙে তছনছ হয়ে গেছে। মানুষ যেন অনেকটা দিকভ্রান্ত, বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে বেশি আশা নিরাশার দোলায় দুলছে।
প্রথম দিকে যখন করোনায় মৃত্যুর ভয়াবহতা আমাদের হতবাক করে দিয়েছিল, তখন মনে হয়েছিল এত মৃত্যু, এতটা অসহায়ত্ব মানুষের মনোজগতে যেভাবে আঘাত করলো সেটা হয়তো মানুষের চেতনাকে আমূল বদলে দেবে। আরো বেশি মানবিক বা সচেতন করে তুলবে। অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষ আগামী দিনের পরিকল্পনা করবে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে মানুষ আরো বেশি এককেন্দ্রিক হয়ে উঠছে। তার বড় কারণ হলো অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই অনিশ্চয়তা অর্থ কেন্দ্রিক। জনসংখ্যার ব্যাপক একটা অংশ কর্মক্ষেত্রে অনিশ্চয়তায় ভুগছে। বেসরকারি ও ক্ষুদ্র শিল্প কারখানায় কর্মী ছাটাই, বেতন ভাতা কমে যাওয়া ইত্যাদি মানুষের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা স্বপ্নহীন অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দিয়েছে।
আমাদের টান পড়েছে সম্পর্কের আন্তরিকতায়। করোনা সময় আমাদের হয়তো শেখাতে চেয়েছিল শারীরিক দুরত্ব বজায় রাখা যতটা জরুরী, মানসিক দুরত্ব নয়। আমরা শিখেছি উল্টোটা। বাইরে বের হলে অবস্থাদৃষ্টে অন্তত তাই মনে হয়। হয়তো পরিস্থিতি আমাদের বাধ্য করেছে "চাচা আপন প্রাণ বাঁচা'' প্রবাদবাক্যটি রপ্ত করতে!
করোনা কাল আমাদের আরো একটা বিষয়ে অভ্যস্থ করে ফেলেছে, সেটা হলো ইন্টারনেট নির্ভরতা। শিক্ষা কার্যক্রম, অফিস ব্যবস্থাপনা তো বটেই, তাছাড়াও দৈনন্দিন যোগাযোগ বা ভাব আদান-প্রদান ইত্যাদির গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে ইন্টারনেট। আমরা ডিজিটাল দেশে বাস করি। ফোর-জি, ফাইভ-জি, আমাদের গতি, কিন্তু আমরা যারা ইন্টারনেট ব্যবহার করি বা সাধারণ শিক্ষার্থী যারা বর্তমান ইন্টারনেট নির্ভর ক্লাসের আওতায় শিক্ষা গ্রহণ করছেন সবাই-ই জানেন, কত রকম হ্যাপা পোহাতে হয় সেক্ষেত্রে। 'কাজীর গরু কিতাবে আছে গোয়ালে নেই' মতো-- নামে ফোর-জি কাজে বাংলাদেশের কোন জায়গা থেকেই ঠিকমতো নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। ফোন কোম্পানিগুলোর গালভরা বিজ্ঞাপন আমাদের আকৃষ্ট করলেও কাজের বেলায় ফলাফল খুবই নিম্নমানের। শহরে থেকেও এঘর থেকে ওঘরে নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না অনেক সময়। এই সংক্রান্ত ভোগান্তি যে মানুষের কতটা চরমে তা শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বললে পরিষ্কার বোঝা যায়।
যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্রের সাথে কথা বলে জানা গেল, তাদের ব্যাচের ২৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ১৫ জন শিক্ষার্থী মোটামুটি অনলাইন ক্লাসে যোগ দিতে পারেন। বাকিদের কারো স্মার্ট ফোন কেনার সামর্থ্য নেই, অথবা ফোন থাকলেও ইন্টারনেট ব্যয় বহন করার ক্ষমতা নেই। সরকারি সহযোগিতাও সবক্ষেত্রে অপ্রতুল এবং সময়সাপেক্ষ। গ্রামাঞ্চলের অবস্থা আরো খারাপ।
করোনাকালকে মোকাবেলা করে যদি আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে সামনে এগোতে হয় তাহলে আমাদের ইন্টারনেটের গতি সত্যিকার অর্থেই সাবলীল ও সহজলভ্য করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় যেমন পরিবর্তন আসছে, সেই সাথে তা যেন শিক্ষার্থীদের যথাযোগ্য উপযোগী হয় সেই ব্যাপারে নিশ্চিত করতে হবে। শহর থেকে গ্রামে অবাধ এবং ফ্রি নেটওয়ার্কিং এর আওতায় আনতে হবে। কথায় বড়ো না হয়ে কাজে প্রমাণ করতে হবে আমাদের দেশ সত্যিকার অর্থেই ডিজিটাল বাংলাদেশ।