
এরিস্টটলের সেই বিখ্যাত উক্তি ‘সুস্থ দেহে সুস্থ মন তৈরি করাই হল শিক্ষা’। কোমলমতি শিশুদের বিদ্যালয়ে প্রাত্যহিক সমাবেশে প্রার্থণা করার মধ্য দিয়ে মহান সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভক্তি ও আনুগত্যবোধ সৃষ্টি হয়। এরপর সমস্বরে শপথবাক্য পাঠ ও জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে শিশুকাল থেকেই তাদের মনে নীতি, নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমের বীজ বপন করা হয়। তারপর ক্লাসে পড়া, টিফিনে মুক্তমনে বিদ্যালয়ের মাঠে খেলাধুলা, বন্ধুদের সাথে গলা জড়াজড়ি, ভাগাভাগি করে টিফিন খাওয়া, একজনের পানির পট থেকে একাধিকজন মুখ লাগিয়ে পান করা-এগুলো শিশুদের সহজাত প্রবৃত্তি। এছাড়া টিফিন ও ছুটির পরে সহপাঠ্যক্রমিক আরও বিভিন্ন কার্যাবলীর সাথে সম্পৃক্ত থাকে অনেক শিশু। যেমন: নাচ, গান, আবৃত্তি, বিতর্ক, অভিনয়, ছবি আঁকা ইত্যাদি। শিক্ষক যে কাজ দেন বাড়ি ফিরে তা তড়িঘড়ি করার জন্যে ব্যস্ত হয়ে যায়। এতেই যেন ওদের মহা আনন্দ, ভালোলাগা, ভালোবাসা, একে অপরের সাথে নিবিড় সম্পর্ক। তারপর শুরু হয় সকালের অপেক্ষায় প্রহর গোনা-কখন দেখা হবে বন্ধুদের সাথে।
এসবের মধ্যেই ধীরে ধীরে বেড়ে উঠা-এটাইতো শিশুর জীবন। এইভাবে ওরা সামাজিকতা শেখে, পরিবার, সমাজ, বাষ্ট্র ও বিশে^র প্রতি দায়বদ্ধতা শেখে। সব মিলে দৈনন্দিন একটা নিয়মিত রুটিনের মধ্যে তারা চলে। কিন্তু, প্রায় আট মাস প্রাণঘাতী করোনার কারণে ঘরবন্দি রয়েছে শিশুরা। শহরের অধিকাংশ শিশু সূর্যের আলো, খোলা হাওয়া ও মুক্ত পরিবেশ থেকে বঞ্চিত। বিকেলে প্রতিবেশী বন্ধুদের সাথে খেলতে যাওয়া, ছুটির দিনে ঘুরতে বের হওয়া ও আত্মীয়-স্বজনের বাসায় যাওয়া বন্ধ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যথার্থই বলেছেন, ‘শিখিবার কালে, বাড়িয়া উঠিবার সময়ে, প্রকৃতির সহায়তা নিতান্তই চাই। গাছপালা, স্বচ্ছ আকাশ, মুক্ত বায়ূ, নির্মল জলাশয়, উদার দৃশ্য ইহারা বেঞ্চি এবং বোর্ড, পুঁথি এবং পরীক্ষার চেয়ে কম আবশ্যক নয়’। পৃথিবীব্যাপী এই মহামারির সময়ে স্মার্টফোন, কম্পিউটার, ল্যাপটপ ও টেলিভিশন দেখে সময় পার করছে তারা। এতে তাদের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে এবং তারা সামাজিক, মানসিক ও শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। অনেক শিশুর মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাচ্ছে, অল্পতে রেগে যাচ্ছে, খাাওয়া-দাওয়ার প্রতি অনীহা ও লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। এসময় অনেক শিক্ষার্থীর ঝরে পড়ার আশংকা আছে।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে শিশুদের উজ্জীবিত রাখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ করলেও সে ব্যবস্থা কতকুটু কার্যকরী হচ্ছে তা ভাববার বিষয়। শহরের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলো অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণ করেছে। কিন্তু সেখানে স্বচ্ছতার অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনলাইনে লাইভ ক্লাস ও জুম অনলাইন ক্লাস বিপুল পরিসরে হলেও সবাই এ সুযোগ পাচ্ছে না। অবশ্য এই ক্লাস শহরের অভিজাত পরিবারের ছেলেমেয়ে ছাড়া অন্যদের সাধ্যের বাইরে। রেডিও, স্থানীয় কেবল নেটওয়ার্ক ও সংসদ টেলিভিশনে প্রচারিত ক্লাসের ক্ষেত্রে একই অবস্থা। এপিজে আব্দুল কালাম বলেছেন, ‘ছাত্রদের মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ যে বৈশিষ্ট্যটা থাকা দরকার তা হলো প্রশ্ন করার ক্ষমতা, তাদের প্রশ্ন করতে দিন’। কিন্তু অনলাইনে বক্তৃতা পদ্ধতিতে এককেন্দ্রীক ক্লাস হওয়ায় শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করার সুযোগ পায়না আর এখানে শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নেরও সুযোগ থাকে না। ফলে শিশুদের মধ্যে একঘেয়েমি সৃষ্টি হয় ও ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে। মাধ্যমিক পর্যায়ে সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে বিদ্যালয়ে মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা হলেও প্রাথমিক পর্যায়ে সংক্ষিপ্ত পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করলেও কোনো মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা হয়নি। অনেক অভিভাবকের প্রত্যাশা ছিল তাদের সন্তানেরা পঞ্চম, অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পাবে। এতে করে যারা অধিক বেতন দিয়ে ব্যয়বহুল স্কুলগুলোতে পড়ান তাদের বিনা বেতনে পড়ার একটা সুযোগ থাকবে। তারা এখন হতাশাগ্রস্ত।
হয়তো এ ব্যাপারে সরকারের মহৎ পদক্ষেপ থাকতে পারে। একটি জাতির উন্নতির সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছানোর প্রধান হাতিয়ার হলো শিক্ষা। তাড়াতাড়ি মহামারি কাটুক এবং আমাদের কোমলমতি শিশুরা স্কুলে ফিরে যাক। বিদ্যালয়ের আঙিনা এইসব সুন্দর পুষ্পের পদচারণায় মুখরিত হোক।
লেখক: সহকারী শিক্ষক, যশোর শিক্ষা বোর্ড সরকারি মডেল স্কুল