
(পূর্ব প্রকাশের পর)
প্রাচীনকালে আহার, বিহার সংযম থাকায় মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস চলত দৈনিক (২১,৬০০) একুশ হাজার ছয়শত বার। তখন মানুষ ছিল শতায়ু। এখন মানুষ অসংযমী হওয়ায় শ্বাস-প্রশ্বাস চলছে (২৫,৯২০) পঁচিশ হাজার নয়শত বিশ বার। এজন্য আয়ু কমেছে। সাধনায় “প্রাণায়াম” দ্বারা এই বায়ু নিয়ন্ত্রিত করা যায়। প্রাণায়াম দ্বারা আমাদের ইন্দ্রিয়গুলির কার্যকারিতা শিথিল হয়ে ‘কাম’ দূরীভূত হয়।
আমাদের দেহ সাতটি রস, সাতটি বর্ণ এবং সাতটি ধাতু দ্বারা গঠিত। হিন্দু পুরাণে সপ্ত সমুদ্রের কথা বলা হয়েছে। জিহ্বা এগুলির স্বাদ বুঝতে পারে। দেহতত্ত্ব নিয়ে ঋষিগণ মন্ত্র লিখে গেছেন ঃ লবণ, ইক্ষু, সুরা, সর্পি, দধি, দুগ্ধ, জলান্তকা-এই সাতটি রসের খেলা চলছে দেহে। দেহের সাতটি ধাতু থেকে এই সকল রস এবং স্বাদ উৎপন্ন হয়। ১) রস = ইক্ষু (মিষ্টি) ২) রক্ত = লবণ ৩) মাংস = দধি (টক) ৪) মেদ = সর্পী (ঘৃত) ৫) মজ্জা = সুরা (মদ) ৬) মগজ = জলান্তকা (অগ্নি) এবং ৭) শুক্র = দুগ্ধ। রক্ত নিহিত রসে (ঝবৎঁস) গ্লুকোজ থাকে এজন্য মিষ্টি স্বাদ। মাংসের স্বাদ টক ইত্যাদি।
শুক্রই জীবন শক্তির ধারক। শক্তি ও মেধার মূল উৎস শুক্র। নাভির নিচে প্রোষ্টেট গ্লান্ড থেকে কিছু উপরে দুটি শুক্রকোষে অসংখ্য শুক্রকীট জন্ম নেয়। ধৃতবীর্য ছাড়া তেজস্বী হওয়া যায় না। গাঢ় শুক্রে শক্তি স্ফুরিত হয়। এটাই ‘ওজঃশক্তি’। নিম্নদিকে ধাবিত তরল শুক্রে ‘কাম’ বৃদ্ধি পায়। মহাপুরুষদের প্রজ্ঞা এবং শক্তি বিকাশের উৎস এই মূল্যবান শুক্র। একে অপচয় করা মনুষ্য ধর্ম নয়। মাসে একবার শুক্র সমুদ্রে জোয়ার আসে এজন্য খনার বচনটি সত্যই প্রণিধান যোগ্য। ‘মাসে এক, বছরে বারো তার কম যত পারো।’ সংযমী পুরুষেরাই পুরুষ সিংহ। কামুক ব্যক্তিগণ জীবনে প্রতিষ্ঠা পান না। তারা নিন্দনীয়। মনুষ্য চরিত্র, শুদ্ধ ও পবিত্র বানাতে ব্রহ্মচর্য্য পালন অর্থাৎ বীর্য্যধারন একান্ত আবশ্যক। হীনবীর্য্য ব্যক্তিগণ দুরারোগ্য ব্যাধিতে অকাল মৃত্যুবরণ করেন।
বীর্য্যধারণে সংযমী ব্যক্তি, মনকে বশে এনে দেহখন্ডে শক্তির উৎসস্থানে ভ্রমণ করে সাধনার স্তর ভেদ করে ব্রহ্মতালুতে আত্মার স্বরূপ উপলব্ধির ক্ষমতা অর্জন করেন। একেই বলে ‘ষট্্চক্র’ সাধনা। দেহখন্ডে অবস্থিত শক্তির উৎসগুলিতে মনস্থির করতে সক্ষম হলে সাধক সিদ্ধযোগী হয়ে সৃষ্টিকর্তার সান্নিধ্য লাভে সক্ষম হন। বীর্য্যবান ব্যক্তি ছাড়া সাধনার উচ্চমার্গে উঠা অসম্ভব। ভারতীয় সাধকেরা এইভাবে আত্মার শক্তি অর্জনে ঈশ্বর সমতুল্য হয়ে যান।
মনকে দেহের এই চক্রগুলিতে স্থির করাই ষট্্চক্র সাধন। এগুলি যথাক্রমে ১) মূলাধার ২) স্বাধিষ্ঠান ৩) মনিপুর ৪) অনাহত ৫) বিশুদ্ধ ৬) আজ্ঞাচক্র ৭) সহস্রার।
মেরুদন্ডস্থ তিনটি নাড়ী সাধকদের শক্তি সঞ্চয়ের সহায়ক। এরা ইড়া, পিঙ্গলা ও সুষুম্না। ইড়া পিঙ্গলা মেরুদন্ডের দুই পাশে এবং সুষুম্না মেরুদন্ডের ভিতরে অবস্থিত। সুষুম্নাকে জাগরণের নাম ‘সাধনা’। মনোযোগের কারণে সাধকের দেহবোধ তিরোহিত হয়। যোনী মন্ডল বা মূলাধার থেকে এই তিনটি নাড়ীতে প্রাণায়ামের সাহায্যে বায়ুর নিয়ন্ত্রণ দ্বারা মনকে সহস্রার বা ব্রহ্মতালুতে স্থিত করাই সিদ্ধ যোগীর সিদ্ধিলাভ বা ব্রহ্মদর্শন। শুক্রে নিহিত অপার শক্তি স্ফুরণে এটি সম্ভব। এজন্য শুক্র ধারণ ক্ষমতা অর্জনে ব্রহ্মচর্য্য পালন প্রয়োজন।
ইড়া, পিঙ্গলা, সুষুম্না মস্তিষ্কের যে স্থানে মিলিত হয়েছে সে স্থানটিকে ‘ত্রিবেনী’ বলে। এইখানে কিছু ফুলের গুচ্ছ রাখা হয়। একেই ‘টিকি’ বা শিখা বা ‘চৈতন’ নামে আখ্যা দেওয়া হয়। এটি মস্তকে একটা শিহরণ জাগায়। প্রাণায়ামে আভ্যন্তরীণ বায়ু আকর্ষিত হয়ে লিঙ্গ মুলে বায়ু প্রবেশ করে ব্রহ্মতালুর ব্রহ্মরন্ধ্র দিয়ে আকাশস্থ তড়িৎ প্রবাহে সংযুক্ত হয়। এজন্য সাধনার সর্বোচ্চ স্তর মস্তিষ্কে। এজন্য মস্তিষ্ক মানুষের শ্রেষ্ঠ স্থান। এই মাথা একমাত্র সৃষ্টিকর্তার চরণে নত হওয়া উচিৎ। মস্তিষ্কের শ্রেষ্ঠত্বের আমরা জীবশ্রেষ্ঠ হয়েছি।
লিঙ্গ মূল ও গুহ্যের মধ্যবর্তী স্থানকে ‘মূলাধার’ বলে। লিঙ্গমূলকে ‘স্বাধিষ্ঠান’ বলে। এখান থেকেই কামের উৎপত্তি। নাভিমূলকে ‘মনিপুর’ বলে। নাভি ধমনী ও তেজ সৃষ্টির উৎপত্তি স্থান নাভির সংযোগে মাতৃগর্ভে আমরা গ্রথিত। বক্ষস্থলকে ‘অনাহত’ বলে। এই স্থানে সাধক আত্মার সন্ধান পায়। কণ্ঠ স্থানটিকে ‘বিশুদ্ধ’ বলা হয়। এই স্থানটি ভোগবাসনার স্থান। এজন্য শিবের কণ্ঠে ‘হলাহল’। সাধককে ভোগ বাসনার উর্ধ্বে উঠতে হবে। ভ্রƒযুগলের মধ্যবর্তী স্থানকে ‘আজ্ঞাচক্র’ বলা হয়। এই স্থান ভেদে করে সাধক অনন্তকে উপলব্ধি করেন। শিরোদেশকে বলে ‘সহস্রার’। ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে সাধক মহাব্যোমের রহস্য ভেদ করতে পারেন। সাধকের অন্তর তখন সদা প্রফুল্ল চিত্ত হয়। সনাতনী এই প্রক্রিয়া মানুষকে নিজ স্বরূপ উপলব্ধির সব ব্যবস্থাই করে দিয়েছেন। এজন্যই বলা হয়েছে ‘‘যা আছে পিন্ডে, তা আছে ব্রহ্মান্ডে”। আত্মানাং বিদ্ধি কহড়ি ঃযুংবষভ নিজের স্বরূপ জানবার এটাই উপায়।
আত্মা এবং মন বিষয়ে বলা যায় যে আত্মা যাবতীয় কর্মের কর্তা। ‘আত্মার’ বাসস্থান হৃদয়ে। “ঈশ্বর সর্বভুতানাং হৃদ্দেশ্যে অর্জুন তিষ্ঠতি। গীতা ১৮/৬১ হৃদয়ে অবস্থিত জ্যোতির্ময় এই আত্মা দেহে তড়িৎ চুম্বক শক্তি উৎপাদন করে। অর্থাৎ আত্মা দেহের শক্তির ‘সমষ্টি রূপ’। ব্যাষ্টিরূপটি ছড়িয়ে আছে প্রত্যেক কোষে। মানুষ মনোধর্মী জীব। তাহলে ‘মন’ কী? এটি তো অঙ্গ নয়। মন হচ্ছে দেহস্থ সমষ্টি ও ব্যাষ্টি শক্তির সম্মিলিত একটি ‘বিদ্যুৎ তরঙ্গ’। মনের দুটি বিভাগ- স্থুল মন এবং সূক্ষ্ম মন। মন আছে তাই আমরা মানব। স্থুলমন সর্বদা চঞ্চল এবং ইন্দ্রিয় পরিচালিত। অপরদিকে সূক্ষ্মমন আত্মধর্মী অর্থাৎ অধ্যত্ম বিষয়ে নিমগ্ন। স্থুল মন ছোট ছোট বিদ্যুৎ তরঙ্গ সৃষ্টি করে। মনকে সর্বদা বৃহত্তর তরঙ্গ তৈয়ারী করা অভ্যাস করার জন্য সাধকের সাধনা। সংযমী পুরুষ ভিন্ন মনকে বশে আনতে পারে না। সূক্ষ্ম মন বৃহত্তর বিদ্যুৎ তরঙ্গ তৈয়ার করে।