
খুঁটির বাঁশে ঘুন ধরেছে
নিত্য পোকায় কাটে,
নদীর বুকে চর জেগেছে
নৌকা বাধা ঘাটে।
আমাদের জীবন নদীর চলমান প্রবাহের বুকে চর জেগেছে। গতানুগতিক জীবনধারা পথ বদল করছে। নীতিবোধের শাখা প্রশাখা গুলো মৃতপ্রায়। আদর্শবোধ দ্বিধা-বিভক্ত। এখন আমাদের সন্তানরা জেনে গেছে তারা সময়ের প্রতিযোগিতায় রেসের ঘোড়া। একটু এদিক ওদিক হলেই লক্ষ্য থেকে ছিটকে পড়তে হবে।
তারা ছোট থেকেই জানতে শিখছে প্রাইভেট না পড়লে ভালো রেজাল্ট হবে না। ডোনেশন ছাড়া ভালো স্কুলে ভর্তি হওয়া যাবে না। ঘুষ ছাড়া চাকরী হবে না। যৌতুক ছাড়া মেয়েদের বিয়ে হবে না। সর্বোপরি প্রচুর টাকা ছাড়া কোন ভাবেই সম্মানের সাথে বাঁচা যাবে না। অর্থাৎ তাদের বড়ো হতে হবে টাকা উপার্জন করার জন্য।
জীবন ধারার বদল অবশ্যম্ভাবী। তাকে স্বাগত জানাতেই হয়! আধুনিক বিশ্বায়নের যুগে মানুষের দিন যাপনের পদ্ধতি আরো আধুনিক হবে তেমনটাই কাম্য। কিন্তু মানবিক মূল্যবোধের নীতি আদর্শ বাদ দিয়ে যেনতেন প্রকারে মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে প্রচুর টাকা আর আরাম-আয়েশের উপকরণ সমাজ ব্যবস্থার জন্য হুমকি স্বরূপ।
উন্মুক্ত বাজার ব্যবস্থা আমাদের সামনে তুলে ধরছে আরাম আয়েশের যাবতীয় উপকরণ। চটকদার বিজ্ঞাপনের চোখ ধাঁধানো উপস্থাপনায় নবজাতক থেকে বৃদ্ধ সকলেরই প্রয়োজনীয় থেকে বিলাসিতা সকল দ্রব্যই নাগালের মধ্যে পাওয়া যায়। শুধুমাত্র টাকা থাকতে হবে। একদিকে বিলাসী জীবনের হাতছানি অন্য দিকে টাকার প্রতি আকর্ষণ ভুলিয়ে দিচ্ছে নীতি আদর্শ বোধের পুরনো বুলি। মাত্র কয়েক দশক আগেও সাধারণ মানুষ জানতো না জীবন যাপনের জন্য কোনরকম বিলাশদ্রব্য ব্যবহার অপরিহার্য। একজন শিশু জন্মানো মাত্র কত প্রকার ব্যবহার্য জিনিসপত্রের উপকরণ লাগে। এখন প্রত্যন্ত গ্রামের একজন মাও জানেন কোন কোম্পানির ডায়াপার ব্যবহার করালে শিশুর জন্য সহজ ও আরামদায়ক হয়! অবশ্যই সেটা প্রয়োজন। চাহিদা অনুযায়ী উন্নত জীবন ব্যবস্থা দেশব্যাপি সকলের জন্য সমান হওয়াটাই স্বাভাবিক। কিন্তু চাহিদা তো একজায়গায় সীমাবদ্ধ থাকে না বা চাহিদার কোন নির্দিষ্ট সীমারেখাও নেই। অর্থের জোগান যত বাড়ে চাহিদা তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে। এই অর্থের চাহিদা এবং প্রাপ্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে আদর্শ, নীতিবোধ ও সততা। সততা বা নীতিবোধের বাঁধ যখন ভেঙে যায় অর্থের বৈধ- অবৈধতা তখন গৌণ হয়ে যায়। চাই-- আরো চাই এই তাড়নায় দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে টাকার পিছে ছুটতে থাকে। যার উদাহরণ আমরা প্রতিনিয়তই দেখতে পাই। এভাবেই একশ্রেণির মানুষের হাতে অবৈধ টাকার পাহাড় গড়ে ওঠে। আর অন্য শ্রেনী নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়।
করোনার প্রাদুর্ভাবে ২০২০ সালে তা যেন আরো প্রকটভাবে সামনে এসে পড়েছে। একের পর এক উন্মোচিত হচ্ছে দুর্নীতি- অনিয়মের পর্দা। জীবন মরণ সমস্যার সমাধান খুঁজতে যেয়ে যেমন আমাদের প্রতীয়মাণ হয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের ভিতরে নড়বড়ে অবস্থা। করোনার ধাক্কায় ঘুণে ধরা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গা থেকে পলেস্তরা খসে পড়েছে। স্বাস্থ্য বিভাগের শরীরে করোনার থেকেও শক্তিশালী ভাইরাস যেন ঝাঁঝরা করে ফেলেছে ভিতরের অস্থিমজ্জা। এই সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য তেমনই প্রমাণ করে। যেমন 'স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিট' এর স্বাস্থ্য সেবা অর্থায়ন কৌশলপত্র, (২০১২- ২০৩২)সর্বশেষ হালনাগাদ ৭ অক্টোবর ২০২০, বিবিসি নিউজ বাংলা-- করোনা ভাইরাস: বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নাজুক অবস্থার কারণ কী?১১ মে ২০২০, এবং 'স্বাস্থ্য খাতের উন্নতি শুধু বরাদ্দে হবে না' শীর্ষক ড. ফাহমিদা খাতুন: নির্বাহী পরিচালক (সিপিডি) ১৪মে,২০২০ রিপোর্ট গুলো দেখি এক নজরে আমাদের চোখের সামনে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ব্যবস্থাপনার ঘূনে ধরা চিত্র ফুটে ওঠে। আমরা সেসব খবর একের পর এক শুনছি, দেখছি। আবহাওয়া জনিত কিছু সুবিধা পাওয়ার কারণে হয়তো করোনা ভাইরাস ইউরোপ, আমেরিকার মত মরণকামড় বসাতে পারেনি নয়তো বেঁচে থেকে লেখার সুযোগ বা পড়ার অবসর কারোরই থাকতো কিনা যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
শুধু স্বাস্থ্যখাতই নির্দিষ্ট নয়, সদ্য পাওয়া সংবাদে বিআরটিএ এর প্রতিদিনের ঘুষ লেনদেনের যে অংক চোখে পড়লো তাতে চক্ষু চড়কগাছ হতে বাধ্য। রোড সেফটি ফাউন্ডেশন সড়ক দুর্ঘটনার যে তথ্য প্রকাশ করেছে তা নিতান্তই হালকা মনে হলো। যেভাবে টাকার বিনিময়ে গাড়ির ফিটনেস সার্টিফিকেট দেয়া হয় তাতে এখনো বেঁচে আছি তাই তো বেশি। এছাড়াও রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের বালিশ কেনা, ইন্ডিপেন্ডেট টিভি'র তালাশ টিমের অনুসন্ধান অনুযায়ী শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের টিনের ছাপড়া ও নারকেল গাছ সহ বিভিন্ন জিনিসের দাম কয়েক কোটি টাকার হিসেব দেখলে আমাদের মত সাধারণ মানুষের মাথা ঘুরে যায়।।
আমরা লেবাসে, হাবভাবে বিশাল ধার্মিক। মুখে বড়ো কথার ফুলঝুরি, শুধু ভিতরটা ঘূনপোকায় খাওয়া নড়বড়ে কাঠামো। এই প্রসঙ্গে বাস্তব অভিজ্ঞতার একটা ঘটনা মনে পড়লো। বছর দশ-বারো আগে যে বাসাটায় ভাড়া থাকতাম সেই বাসায় একদিন কিছু চাঁদাবাজের আগমন হলো। বাড়িওয়ালার কাছে চাঁদা চায়। বাড়িওয়ালা এত টাকা ভাড়া পান তাই তাদেরও কিছু ভাগ দিতে হবে। উনারা কোন দল করেন না তবে এলাকাটা উনাদের। বাড়িওয়ালা যেহেতু এই বাড়িতে থাকেন না তাই আমাদের কথা বলতে হলো। চাঁদাবাজদের মধ্যে যিনি কথা বলছিলেন একপর্যায়ে তার একটা ফোন আসে। রিংটোন শুনে তো আমি অবাক। জাতীয় সঙ্গীত বাজছে। একটু বেশি কৌতুহলী হয়ে পড়ার কারণে আমি একটু উঁকি দিয়ে দিয়ে ফোনের দিকে তাকাতেই দেখি আমাদের দেশের বরণীয় একজন নেতার ছবি। আমি ততক্ষণে স্তম্ভিত হয়ে গেছি, একজন দেশবরেণ্য নেতার ছবির দিকে তাকিয়ে, জাতীয় সঙ্গীত কানে শুনে কেউ চাঁদা চাইতে পারে তা আমার মাথায় তখনও ঢোকেনি এবং আজো তা বোধের অগম্য। সত্যিই এদের কোন দল নেই, দেশ নেই, মা- মাতৃভূমির বোধ নেই। এই শ্রেণির মানুষ যে শুধু রাস্তায় থাকবে তেমন তো নয়, এদেরই কিছু অংশ লেখাপড়া শিখে যখন সরকারের কর্মযজ্ঞে সামিল হয় তখন তাদের সীমাহীন লোভের লাগাম টেনে ধরার শক্তি যেন খোদ সরকারেরও থাকে না। অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে তাদের ঘুষ, দুর্নীতি, লুটপাট বাণিজ্য।
# লেখক: সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও নারী নেত্রী