বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে সরকার অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিতকরণে অঙ্গিকারবদ্ধ। এই লক্ষ্যে সরকার ১৯৯০ সালে সংসদে ‘বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা আইন’ পাশ করে এবং তা ১৯৯২ সালের ০১ জানুয়ারিতে প্রথম পর্যায়ে ৬৮ টি উপজেলায় এবং পরবর্তিতে ১৯৯৩ সালের জানুয়ারি মাসে সারাদেশে এই আইন কার্যকর হয়। শিক্ষার পরিমাণগত এবং গুণগত মানোন্নয়নে বিভিন্ন সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের কারণে পরিমাণগত অর্জন করতে সক্ষম হলেও গুণগত মান আশানুরুপ করতে সক্ষম হয়নি। গুণগত মান পরিবর্তনে সরকার প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি) এর আওতায় নানামুখি যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তার কতিপয় উল্লেখ করা হলো।
১। শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণসহ নানামুখি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ।
২। ই-মনিটরিং ব্যবস্থাপনার আওতায় বিদ্যালয়, শিক্ষক, শিক্ষার্থী সংক্রান্ত তথ্য হালফিল করা সহ সকল পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পরিদর্শন নিশ্চিত করার তাগিদ দেয়া হয়েছে।
৩। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে ৩৬১৭৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণের এক সাহসী ও যুগান্তকারী ঘোষণার মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন তথা জাতীয় অগ্রযাত্রার ভিত রচনার পর তাঁরই ধারাবাহিকতায় বঙ্গবন্ধু কন্যা ও প্রধানমন্ত্রি শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে ২৬১৯৩টি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণের মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার ইতিহাসে এব অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
৪। স্লিপ ও ইউপেপ কার্যক্রমের আওতায় বিদ্যালয় কেন্দ্রিক কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য বরাদ্দ প্রদান করা হচ্ছে। এই পরিকল্পনার আওতায় ভৌত অবকাঠামো, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা, এসএমসি সভা, উপস্থিতির হার বৃদ্ধি, মা সমাবেশ, হোম ভিজিট, শ্রেণিকক্ষ সজ্জিতকরণ, উপকরণ ক্রয়, পাঠটীকা তৈরি, শিক্ষার্থীদের খেলনা সামগ্রী, আসবাবপত্র ক্রয়, বাউ-ারী নির্মাণ, টয়লেট, বাগান তৈরি, হতদরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য ইউনিফর্ম ক্রয়, বিদ্যালয়ের বাহ্যিক পরিবেশ আকর্ষণীয়করণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।
৫। সারাদেশে বিদ্যালয়ে ল্যাপটপ প্রদান সহ ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শ্রেণিকক্ষে শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।
৬। ফিল্ড পর্যয় থেকে ইনোভেশন আইডিয়া সংগ্রহ করে তা বাস্তবায়নের কার্যক্রম চলমান আছে।
৭। পিটিআইতে ১৮ (আঠারো) মাস মেয়াদী ডিপিএড কোর্স চালু সহ শিক্ষকদের শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার কৌশল আয়ত্ত্বের জন্য আইসিটি ইন এডুকেশন বিষয়ের উপর পিটিআইতে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
৮। প্রশিক্ষণ চাহিদা নিরুপন, চাহিদা অনুযায়ী সাব-ক্লাস্টার ম্যাœুয়াল তৈরি ও ফিল্ড পর্যায়ে চাহিদা ভিত্তিক সাব-ক্লাস্টার প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন হচ্ছে।
৯। কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়ন হচ্ছে।
১০। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পুনঃনির্মাণ ও সংষ্কার প্রকল্পে ৪৮৫০টি বিদ্যালয় পুনঃনির্মাণ ও সংষ্কার এবং টিউবওয়েল ও টয়লেট স্থাপন ও আসবাবপত্র সরবরাহ।
১১। ইংলিশ ইন এডুকেশন প্রকল্পে ৬৪ জেলার ৫১০০০ (একান্ন হাজার) শিক্ষককে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে।
১২। বিদ্যালয়বিহীন এলাকায় ১৫০০ বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে।
১৩। ৭৮ লক্ষ শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি প্রদান ১৮০টি প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবন নির্মাণ, ১২টি পিটিআই প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষার গুনগত মানোন্নয়নে সুপারিশ
১। মনিটরিং ব্যবস্থাপনায় গতিশীলতা আনা। এক্ষেত্রে জেলা পর্যায়ে মনিটরিং ইউনিট গঠন করে তাদের মাধ্যমে মনিটরিং কার্যক্রম পরিচালনা করা।
২। শিক্ষার্থীদের প্রমিত উচ্চারণে,সঠিক অভিব্যক্তি সহকারে সুখশ্রাব্য গতিতে পঠন এবং সঠিক প্রবাহে সপ্ত-স বজায় রেখে লিখন দক্ষতা বৃদ্দিতে শিক্ষকদের মধ্যে আন্তরিকতা বৃদ্ধি করা।
৩। পরিদর্শনকারী কর্মকর্তার জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।
৪।বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক এবং সহকারী শিক্ষকদের নিয়মিত সকল কাজের জবাবদিহিতার আওতায় আনা।
৫। সকল শিক্ষকের নিয়মিত উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। অনুপস্থিত শিক্ষকের বিরুদ্ধে গণকর্মচারী শৃঙ্খলা (নিয়মিত উপস্থিতি) অধ্যাদেশ, ১৯৮২ ও গণকর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮, এবং সংশোধিত বিধিমালা ২০২০ এর আওতায় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হব্।ে
৬। শিক্ষার্থী উপস্থিতি নিশ্চিত করতে এবং ঝরে পড়া রোধে নিয়মিত হোম ভিজিট, মা সমাবেশ, উঠান বৈঠক, এসএমসি সভা, পিটিএ কার্যক্রম মনিটরিং এর আওতায় এনে তা বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
৭। মিড-ডে মিল চালুর মাধ্যমে শিক্ষার্থী অনুপস্থিতি অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব। যে সব বিদ্যালয়ে হতদরিদ্র পিতা-মাতার সন্তানেরা পড়াশুনা করে তাদের ক্ষেত্রে মিড-ডে মিল চালুর বাস্তবায়ন জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন।
৮। দৈনিক সমাবেশে শিক্ষার্থীদের নীতি বাক্য শেখাতে হবে ও ইতিবাচক স্বপ্ন দেখাতে হবে।
৯। শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে তুলতে পুরস্কারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। মাসে বিদ্যালয়ে একবার স্টুডেন্ট অব দ্যা ডে চালু রাখতে হবে।
১০। পড়ো সর্দার ব্যবস্থাপনা বা পারগ শিশুদের দ্বারা অপারগ শিশুদের শিখন নিশ্চিত করতে হবে।
১১। শিশুদের বিদ্যালয় ভীতি দূরীকরণের জন্য শিখন-শেখানো কার্যাবলিতে আবেগ সৃষ্টি, বেতের ব্যবহার না করা, ভয়-ভীতি প্রদর্শন না করা, পদ্ধতি ও কৌশল মোতাবেক পাঠদান, আকর্ষণীয় উপকরণের ব্যবহার, শিক্ষার্থী কেন্ত্রিক পাঠদান, ভাল ফলাফলকারী শিক্ষার্থীদের পুরষ্কার প্রদান, উৎসাহিত প্রদান যেমন:- (খুব ভালো হয়েছে, সাবাস, ধন্যবাদ ইত্যাদি), শিক্ষার্থীদের প্রতি সমদৃষ্টি প্রদান, বন্ধুসুলভ আচরণ, সহশিক্ষাক্রমিক কার্যাবলিতে সম অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি করা।
১২। শিক্ষকদের শ্রেণীভিত্তিক পাঠ্যবইয়ের জ্ঞানের গভীরতা বৃদ্ধি করার বিষয়ে উৎসাহিত করা। শিখন শেখানো কার্যক্রমের পূর্বে পাঠ পরিকল্পনা প্রনয়ন ও পাঠ পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে পাঠউপকরণ সহকারে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা বিষয়ে যথাযথ মনিটরিং করা।
১৩। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা উঠিয়ে দিয়ে ধারাবাহিক/পাঠনিক মূল্যায়নের মাধ্যমে পরবর্তী শ্রেণিতে উত্তীর্ণ করার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। শিক্ষার্থীদের কারিকুলাম অনুযায়ী যোগ্যতাভিত্তিক মূল্যায়নে অভ্যস্ত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের শিখন ঘাটতি দূরীকরণে সকল শিক্ষককে আন্তরিক সহকারে পাঠদান নিশ্চিত করতে হবে।
১৪। শিক্ষক বছরের শুরুতে বেজলাইন সার্ভে করে পারগ-অপারগ শিশু চিহ্নিত করে অপারগ শিশুদের পারগতা বৃদ্ধিতে নতুন নতুন পদ্ধতি ও কৌশল আবিষ্কার করতে হবে এবং সে অনুযায়ী শিখন-শেখানো কার্যাবলি পরিচালনা করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে হবে।
১৫। শিক্ষক/ শিক্ষার্থী পারফরম্যান্স রিপোর্ট বিদ্যালয়ে নিয়মিত হালফিল হচ্ছে কিনা তা বিদ্যালয় পরিদর্শনের সময় মনিটরিং করতে হবে। এবং প্রয়োজনীয় ফিডব্যাক দিতে হবে।
১৬। কার্যকর এসএমসি কমিটি নিশ্চিত করতে হবে।
১৭। কৃতি শিক্ষার্থী ও কৃতি শিক্ষার্থীর পিতা-মাতাকে পুরষ্কৃত করতে হবে।
১৮। শিক্ষকদের শিক্ষকযোগ্যতার মান নিরুপন করতে হবে শিক্ষকযোগ্যতার ঘাটতি থাকলে পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধিতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং প্রশিক্ষলব্ধজ্ঞান বাস্তবে প্রয়োগ করতে উৎসাহিত করা।
১৯। প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার ভিত্তিকে উচ্চতর ডিগ্রিধারীদের মধ্যে হতে যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগ প্রদান করতে হবে।
২০। এমন শিক্ষাক্রম চালু করা যাতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা পেশায় আসতে হলে তাকে ঐ বিষয়ের উপর লেখাপড়া করে আসতে হবে। ফলে প্রাথমিক শিক্ষায় নবতর ধ্যান-ধারণা সৃষ্টিতে শিক্ষকদের আগ্রহ সৃষ্টি হবে।
২১। শিক্ষকদের বিষয়জ্ঞানের উপর প্রতি দুই বছরে একবার ইন-সার্ভিস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুৃযোগ সৃষ্টি করতে হবে। ভাল ফলাফলধারী শিক্ষকদের সনদপত্রসহ পুরষ্কারের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এর ফলে শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে।
২২। প্রতি বিদ্যালয়ে টিচার্স সাপোর্ট নেটওয়ার্ক (টিএসএন) চালু রাখতে হবে। এতে শিক্ষক তার শিখন-শেখানো দূর্বলতা দূরীকরণের সুযোগ পাবে। টিচার্স সাপোর্ট নেটওয়ার্ক (টিএসএন) এর আওতায় শিখন-শেখানো কার্যাবলিতে পরিদর্শনকারী কর্মকর্তা ও অন্যান্য শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শের মাধ্যমে নিজেকে যোগ্য শিক্ষক হিসাবে প্রকাশিত করতে পারবে।
২৩। নিয়মিত বিদ্যালয়ে দেয়ালিকা প্রকাশ, কাবিং কার্যক্রমে গতিশীলতা, সততা স্টোর, মহানুভবতার দেয়াল,পরিস্কার পরিচ্ছন্œতা, সততা ও নৈতিকতার শিক্ষা চর্চা, বিভিন্ন দিবস পালন, বিদ্যালয়ের আঙ্গিনায় ফুল ও সবজির বাগান, ইউনিফর্ম নিশ্চিতকরণ, ভর্তি ও উপস্থিতির হার বৃদ্ধিতে প্রাথমিক শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকল পরিদর্শণকারী কর্মকর্তার নিবিঢ় মনিটরিং প্রয়োজন।
২৪। বছরের শুরুতে বেজলাইন সার্ভে করে শিক্ষার্থীদের পারগতার অবস্থান যাচাই করে সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
উপরোক্ত কার্যক্রমগুলির যথাযথ বাস্তবায়ন করতে পারলে প্রাথমিক শিক্ষার গুনগত মান উন্নয়ন তরান্বিত হবে।
# লেখক: ইন্সট্রাক্টর, উপজেলা রিসোর্স সেন্টার, যশোর সদর, যশোর।