
সড়ক দুর্ঘটনা বর্তমানে এমন একটা অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে যা আমাদের প্রায় প্রতিদিনের সংবাদ শিরোনাম। বিষয়টি নিয়ে বার বার লেখা হচ্ছে, পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে কিন্তু দুর্ঘটনা অবিরাম গতিতে ঘটেই চলেছে। প্রতিনিয়তই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে মর্মান্তিক সব দুর্ঘটনায় আহত- নিহতের খবর পাওয়া যায় সংবাদ মাধ্যমে। সড়কে প্রাণ ঝরছে প্রতিদিন। বাইরে বেরিয়ে নিরাপদে ঘরে ফেরার অনিশ্চয়তা যেন এই জনপদের নিয়তি হয়ে উঠেছে। জনসংখ্যা বাড়ছে, পাল্লা দিয়ে পরিবহনের সংখ্যা বাড়ছে সেই তুলনায় রাস্তার স্থান সংকুলানের ব্যবস্থা নেই। এটা যে একটা কঠিনতম সমস্যা যা দিন দিন ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা রীতিমতো পিলে চমকানোর মতো। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সরকারের তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ বা ব্যবস্থা নেয়ার পরিকল্পনা জনসাধারণের নজরে আসছে না।
দেশে বিভিন্ন সংগঠন এই বিষয় নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে, প্রতিদিন, প্রতিমাসে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা তারা তুলে ধরছেন। তাদের গবেষণালব্ধ সড়ক দুর্ঘটনার কারণসমূহ এবং করণীয় পরিকল্পনা সরকারের কাছে সুপারিশ করছেন কিন্তু দিন শেষে সেই একই ঘরে না ফেরা মানুষের লাশের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।
প্রথম আলোসহ বিভিন্ন পত্রিকা যা প্রকাশ করেছে তার কিছু রিপোর্ট যদি আমরা তুলে ধরি
দেশ রূপান্তর থেকে নেয়া– বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের রিপোর্ট "বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তার বড়ো কারণ এখনো সড়কে আনফিট গাড়ি দেখা যায়। দক্ষ চালকেরও অনেক অভাব রয়েছে। বিজ্ঞানসম্মত সড়ক ডিজাইন করা হয় না যার জন্য সড়কে যেসব ঝুঁকি আছে সেগুলো রেখেই অবকাঠামো উন্নয়ন হচ্ছে। তাই ঝুঁকিগুলো ঠিক না করলে সড়ক নিরাপদ হবে না।"
রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন "বাংলাদেশের কোনো সড়কই নিরাপদ নেই। সড়ক আইন শুধু কাগজে কলমেই আছে। যার জন্য প্রতি বছর মৃত্যুর সংখ্যা বেড়েই চলেছে আর সড়ক নিরাপত্তার জন্য সরকার কোনো উদ্যোগ নিলেই পরিবহন মালিক ও কিছু সিন্ডিকেট আছে তারা সবসময়ই বাধা সৃষ্টি করে। যার জন্য সড়ক নিরাপদ করা যায় না। তিনি সরকারের আরও কঠোর ভূমিকা নেয়ার বিকল্প নেই বলে মনে করেন।"
এ, এ, ফেরদৌস খান সহসভাপতি, রোড সেফটি ফাউন্ডেশন ও প্রধান নির্বাহী, থিংক সেফটি বাংলাদেশ, জড়ধফং ধহফ ঐরমযধিু এর সড়ক নিরাপত্তা সংক্রান্ত শুদ্ধাচার বিষয়ক অংশীজন সভাতে বলেন
"দুর্বল ব্যবস্থাপনা, অনুপযুক্ত যানবাহন, অনুন্নত অবকাঠামো ও অদক্ষ মানবসম্পদ দুর্ঘটনার কারনগুলোর মধ্যে অন্যতম । তন্মধ্যে দুর্বল ব্যবস্থাপনাই সর্বোপরি দায়ী।"
সড়ক ও পরিবহন নিয়ে কাজ করা সংগঠন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেন "দেশের কর্মক্ষম ব্যক্তিরাই সবচেয়ে বেশি সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হচ্ছে, এর প্রভাব পড়ছে জাতীয় অর্থনীতিতে।" দুর্ঘটনায় নিহত ও আহত ব্যক্তি ও তার উপর নির্ভরশীল ব্যক্তিদের আর্থসামাজিক যে ক্ষতি হচ্ছে বুয়েটের এআরআই এর হিসাব বলছে গত তিন বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় এই ক্ষতির পরিমাণ প্রায় নয় হাজার কোটি টাকা।
মৃত্যু সবসময়ই গভীর বেদনার। তার উপর অকালমৃত্যু বা সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যু মানে একটি পরিবারের মৃত্যু। ঐ পরিবারের প্রতিটি সদস্যকে সারাজীবন সেই ভোগান্তি বয়ে বেড়াতে হয়। তাদের জীবন থেকে স্বপ্ন, পরিকল্পনা এবং আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে এবং রাতারাতি একটি পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার ঘটনা এদেশে প্রতিদিন ঘটছে এবং সেই গল্প কত মর্মান্তিক সে ভুক্তভোগী ছাড়া আর কারও বোধগম্য হওয়ার কথা না। আর যদি আহত হয়ে পঙ্গু অবস্থায় ঘরে পড়ে থাকে তাহলে চিকিৎসার ব্যয় মেটাতে পরিবার সুদ্ধ সবাই পথে নামতে বাধ্য হয়। এরকম মর্মান্তিক দৃশ্য এখন যেন আমাদের গাসওয়া হয়ে গেছে।
গত প্রায় তিন বছর ধরে পৃথিবী জুড়ে করোনা মহামারীতে মৃতের সংখ্যা লক্ষ লক্ষ। আমাদের দেশেও প্রায় ত্রিশ হাজারের মতো। ভয়াবহ ডেঙ্গু জ্বরেও প্রাণহানি আশঙ্কাজনক। কোনো মৃত্যুই কাম্য নয়, সকল অস্বাভাবিক মৃত্যুর বিরুদ্ধে সোচ্চার বা সচেতন থাকা চাই সকলের কিন্তু পার্থক্য হলো এইসব রোগের প্রতিকার নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে তোড়জোড় সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা এবং ভয়াবহতা তার চেয়ে অনেক বেশি মারাত্মক হওয়ার পরেও সরকারের সেই তৎপরতা চোখে পড়ে না।
দুর্ঘটনার ভয়াবহতা নিরূপণে আমরা যদি মৃত্যুর পরিসংখ্যানের দিকে একবার দৃষ্টি দিই– নয়টি জাতীয় দৈনিক, সাতটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যমের তথ্যের ভিত্তিতে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের তথ্যমতে, দেশে গত নয়মাসে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে পাঁচ হাজার ৪৩ জন। এর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত একহাজার ৭৩৬ জন। এছাড়াও শুধু সেপ্টেম্বর মাসেই দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৪৭৩ জন এবং আহত ৭৯৪। এর মধ্যে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ১৬৯ জন। যা মোট নিহতের ৩৫ দশমিক ৫০ শতাংশ। সেপ্টেম্বর মাসে গড়ে দিনে ১৫.৮৬ জন নিহত হয়েছে।
সংগঠনটি বলছে "সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে সড়ক ও পরিবহন খাতে নৈরাজ্য ও অব্যবস্থাপনার কারণে। এই অবস্থার উন্নয়নে টেকসই সড়ক পরিবহন কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা।"
কোথায় আমাদের দুর্বলতা যে আমরা এই পরিমাণ মৃত্যু নিয়েও দিব্যি নিশ্চিন্তে থাকতে পারি! আমাদের সচেতনতার এতো অভাব যে বাড়ির তরুণ ছেলেটির হাতে আমরা মোটরসাইকেল তুলে দিচ্ছি আর সে লাশ হয়ে ঘরে ফিরছে আমরা তখনও নির্বিকার আছি। কিছুটা সচেতনতার তাগিদ আমাদের সকলেরই থাকা দরকার বলে মনে করি। তার জন্য যা যা করা উচিত সেই দায়িত্ব আমরা কেউই এড়াতে পারি না।
এই লাশের বহর থামাতে আমরা কার কাছে আর্জি জানাব! কার কাছে বলি– নিরাপদ সড়ক চাই। স্বাভাবিক মৃত্যুর নিশ্চয়তা চাই।