
১৯৩৬ সালের ৪ আগস্ট বরেণ্য শিক্ষাবিদ অসম্প্রদায়িক চেতনাসম্পন্ন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অসিতবরণ ঘোষ যশোর শহরের বাগমারা পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর আইনজীবী পিতার নাম প্রফুল্ল কুমার ঘোষ ও মাতা রতœপ্রভা ঘোষ।
১৯৫৭ সালে কৃতিত্বের সাথে বি.এ. পাশ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এম.এ পড়ার সময় কঠিন ব্যাধির কারণে অধ্যাপক অসিতবরণ-এর শিক্ষাজীবনে সাময়িক ছেদ পড়ে। এরই অব্যবহিত পরে পিতার দৃষ্টিক্ষীণতা ও শারীরিক প্রতিকূলতার কারণে তাকে উপার্জনের পথ দেখতে হয়। সে-সময় পশ্চিমবঙ্গে একটি বহুজাতিক কোম্পানির মাসিক ৫০০.০০ টাকা বেতনের চাকরি প্রত্যাখ্যান করে তিনি ১৯৫৮ সালের ২ ফেব্রুয়ারি যশোরের সম্মিলনী ইন্সটিটিউশনে মাসিক ১০৫.০০ টাকা বেতনে শিক্ষকতায় যোগদান করেন। পরবর্তীতে এম.এ পড়তে যাওয়ার জন্য স্কুলের কাজে ইস্তফা দিলে স্কুলকর্তৃপক্ষ স্বেচ্ছায় তাকে দুই কিস্তিতে ছুটি মঞ্জুর করেন। এম.এ প্রথম পর্বে দ্বিতীয় এবং চূড়ান্ত পর্বে দশম স্থান অধিকার করে তিনি পুনরায় স্কুলে যোগদান করেন।
১৯৬৩ সালের আগস্ট থেকে অধ্যাপনা জীবন শুরু করে তিনি একে একে কেশবচন্দ্র কলেজ (ঝিনাইদহ), মাগুরা ডিগ্রী কলেজ (মাগুরা), আযম খান কমার্স কলেজ (খুলনা), নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ (নড়াইল), পুনরায় আযম খান কমার্স কলেজ ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় (খণ্ডকালীন) এবং সর্বশেষে সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে শিক্ষকতা করে চাকরি থেকে ১৯৯৩ সালে অবসর গ্রহণ করেন।

সে সময় আর্থিক অসচ্ছলতা সত্ত্বেও অধ্যাপক ঘোষ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার সম্মানজনক চাকরি এবং ঘরে বসে প্রাইভেট টিউশনির সুযোগ প্রত্যাখ্যান করে প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষার প্রতি গভীরভাবে আকৃষ্ট হন। ফলে ১৯৯৬ সালে তিনি খুলনা শ্রী অরবিন্দ সোসাইটির আঙ্গিনায় ‘অরোতীর্থ বিদ্যাপীঠ’ নামে একটি ব্যতিক্রমধর্মী ল্যাবোরেটরি শিশুশিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠা করেন। দীর্ঘ কুড়ি বছর যার পরিচালকের দায়িত্ব তিনি পালন করেন। তিনি শিশুশিক্ষায় চলমান নৈরাজ্য ও নৈরাশ্য নিরসনের লক্ষ্যে ২০০১ সালে খুলনায় Integral Child Development Centre (ICDC) প্রতিষ্ঠা করেন। ঐ প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক হিসেবে তিনি ২০০৩ সালের অক্টোবরে খুলনায় দুইদিনব্যাপী এক ঐতিহাসিক শিশুশিক্ষা কর্মশালার সফল আয়োজন ও উদ্যাপন করেন। প্রায় একই সময়েই তিনি অরোতীর্থ বিদ্যাপীঠে পাঁচ দিনব্যাপী শিশুশিক্ষা মেলার এক অভূতপূর্ব আয়োজন করেন, যা সম্ভবত এ দেশে এক অশ্রুতপূর্ব ঘটনা। কারিতাস, ওয়ার্ল্ডভিশন, নেট্জ, বাংলাদেশসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আমন্ত্রণে তিনি দেশের বিভিন্ন জেলায় শিশুশিক্ষা বিষয়ক বহু প্রশিক্ষণ-কারিকুলাম প্রণয়ন ও প্রশিক্ষণ পরিচালনা করেছেন। প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষায় মারিয়া মন্তেসরি-প্রবর্তিত পদ্ধতির অপরিহার্যতা অনুধাবন করে তিনিই প্রথম বাংলাভাষায় তাঁর তিনটি বিখ্যাত গ্রন্থের অনুবাদ করেন। ২০১৮ সালে অসিতবরণ ঘোষের অন্যবদ্য সৃষ্টি ‘রামমোহন রায়’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
একজন ব্যতিক্রমী শিক্ষক ও শিক্ষার্থী হিসেবে এভাবে নিজেকে উৎসর্গ করা ছাড়াও সংস্কৃতির অন্যন্য অঙ্গনেও তিনি তার কর্মৈষণা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। ১৯৬২-১৯৬৩-তে যশোর ক্রীড়া সংস্থা কর্তৃক যশোরে যে ক্রিকেট লীগ-এর সূচনা হয় তার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তাও ছিলেন তিনি এবং তারই অধিনায়কত্বে ইস্টার্ন ক্লাব যশোরে প্রথম ক্রিকেট লীগ শিরোপা জয় করে।
অধ্যাপক অসিতবরণ ঘোষ-এর একটি বড় পরিচয় ’৭১-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে একজন কলমসৈনিক হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতারে ‘সত্যব্রত’ ছদ্মনামে কথিকা প্রচার। ’৭১-এর নভেম্বর-ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তার রচিত দুটি নাটিকা স্বাধীন বাংলা বেতারে প্রচারের জন্য মনোনীত হয়। তারই একটি ‘রাত্রির তপস্যা’ স্বাধীনতা-উত্তরকালে বাংলাদেশ বেতার থেকে বহুবার প্রচারিত হয়েছে।
এতসব কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করা ছাড়াও তিনি বিগত ৪২ বছর যাবৎ খুলনায় শ্রী অরবিন্দ সোসাইটির কর্ণধার পূর্বে সম্পাদক ও পরবর্তী সময়ে সভাপতি-এর দায়িত্ব পালন করেন। বিগত ১০ বছর যাবৎ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্কুল ভিত্তিক সমন্বিত শিক্ষা-সংস্কৃতি কার্যক্রম, খুলনা শাখার সভাপতি ও প্রাণপুরুষ হিসাবেও তিনি নিরলসভাবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন।
বহুধা বিস্তৃত কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করে একজন উৎসর্গিত শিক্ষক, উদ্দীপনাসঞ্চারী আলোচক, মননশীল লেখক ও সুদক্ষ অনুবাদক হিসাবে প্রভূত সুনাম অর্জন করা সত্ত্বেও অসিতবরণ ঘোষ নিজেকে একজন ছাত্র ছাড়া অন্য কিছুই ভাবতেন না। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি অতীশ দীপংকর থেকে বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত বাঙালি মনীষার ধারাবাহিক অভিযাত্রার স্বরূপ নির্ণয়ে এবং বর্তমান তরুণ প্রজন্মের সামনে তা উন্মোচন করার লক্ষ্যে নিবিড় অধ্যয়ন চালিয়ে যান।
এই বরেণ্য শিক্ষাবিদ অসিতবরণ ঘোষ-এর অনুদিত গ্রন্থসমূহ : দ্য সিক্রেট অব চাইল্ডহুড-মারিয়া মন্তেসরি, আপনার শিশু প্রসঙ্গে আপনার যা জানা উচিত-মারিয়া মন্তেসরি, দি অ্যাবজরবেন্ট মাইন্ড-মারিয়া মন্তেসরি, সেই পরিব্রাজক (দ্য ওয়ান্ডারার)-খলিল জিবরান, পাগল (দ্যা ম্যাডম্যান) ও সেই পরিব্রাজক -খলিল জিবরান, সমূহ পতন (‘All that Fall’)-স্যামুয়েল বেকেট (নোবেল জয়ী ন্যাট্যকার)।
এই কৃতী শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অসিতবরণ ঘোষ ২০২২ সালের ১৩ নভেম্বর সকাল ৬টা ৫৭ মিনিটে খুলনার কয়লাঘাটাস্থ নিজস্ব বাসভবনে বার্ধক্য জনিত কারণে মৃত্যুবরণ করেন।
# লেখক: সাহিত্যিক ও গবেষক।