
লাগাম ছাড়া হয়ে পড়েছে যশোরের কতিপয় আইনজীবী সহকারী। তারা কারও কথাই মানছেন না। কখনো আইনজীবী আবার কখনো বিচারকদের নাম ভাঙিয়ে সেবা প্রত্যাশীদের কাছ থেকে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন। দূর-দূরান্ত থেকে আসা নিরীহ মানুষকে জিম্মি করে প্রতারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ জড়িয়ে পড়েছেন সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে। আটক হচ্ছেন অস্ত্রসহ। আবার কেউ কেউ খোদ জিআরও কক্ষ থেকে নথি চুরির মতো ঘটনা ঘটাচ্ছেন। আবার মক্কেলদের টাকা পয়সাও ছিনিয়ে নিচ্ছেন। কোনো কোনো আইনজীবী সহকারী নিজেরাই নিজেদের একাধিক সহকারী নিয়োগ দিয়ে চালাচ্ছেন নানা প্রতারণা। ওইসব সহকারীরা মানছেন না ড্রেস কোড, ঝুলাচ্ছেন না পরিচয়পত্রও। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত আদালতের হাজতখানার সামনে থেকে নানা ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছেন। গতকালও কাদের নামে একজন আইনজীবী সহকারীর বিরুদ্ধে জাল কাবিননামা তৈরি করে এক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা আত্মসাতের অভিযোগে আদালতে মামলা হয়েছে। এক কথায় আদালত চত্বরে আসা লোকজন কতিপয় আইনজীবী সহকারীর প্রতারণায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছেন। আইনজীবী সহকারী সমিতিসহ বিভিন্ন দপ্তরে অভিযোগ দিয়েও মুক্তি মিলছে না এই দশা থেকে। এসব বিষয়ে জেলা আইনজীবী সমিতির দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন আইনজীবী, প্রকৃত আইনজীবী সহকারীসহ সংশ্লিষ্টরা।
গত ২৫ অক্টোবর আইনজীবী সহকারী রাজুর কাছ থেকে প্রতারিত হয়ে জেলা আইনজীবী সমিতিতে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন গাজীপুরের কাপাশিয়া উপজেলার কোনাসারি গ্রামের রাসেল শেখ। তিনি যশোর আদালতের একটি মামলার আসামি। মামলা নম্বর সিআর ২২১/২০। ওই মামলায় বাদীর সাথে মীমাংসার মাধ্যমে তাকে খালাশ করার নামে এক লাখ ছয় হাজার টাকা হাতিয়ে নেন রাজু। অথচ পুলিশ তাকে ওই মামলায় আটক করে। আটকের পর জামিনে বের হয়ে জানতে পারেন বাদীর সাথে কোনো মীমাংসাই করেননি রাজু। এ কারণে পুলিশ তাকে আটক করে। অভিযোগ রয়েছে, এমন কোনো কাজ নেই যা রাজু করেন না। বেশ কয়েকদিন ধরে আত্মগোপনে রয়েছেন রাজু।
আইনজীবী সহকারী পরিচয়ধারী ইলিয়াস হোসেন বাবু। তিনি আদালতে মাস্টাররোলে চাকরি দেওয়ার কথা বলে ১২ লাখ টাকা হজম করে লাপাত্তা হয়েছেন। এ বিষয়ে কোতোয়ালি থানা ও পুলিশ সুপারের কাছে অভিযোগও দেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রতিকার পাননি যশোর সদর উপজেলার ডহেরপাড়া গ্রামের রবিউল ইসলামের ছেলে সোহানুর রহমান।
আরেক আইনজীবী সহকারীর নাম আলমগীর। তিনি ইতিমধ্যে এক মক্কেলের ব্যাগ থেকে ২০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। এই অভিযোগে গত ২০ অক্টোবর জেলা আইনজীবী সমিতিতে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন ভুক্তভোগী নাসিমা খাতুন। কিন্তু তিনিও কোনো প্রতিকার পাননি।
এর আগে আদালতে কর্মচারী পদে চাকরি দেওয়ার নামে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে সৌরভ সেন নামে এক আইনজীবী সহকারীর বিরুদ্ধে। এ অভিযোগে ভুক্তভোগী সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ঝাঁপা গ্রামের ভবতোষ রপ্তান জেলা আইনজীবী সমিতিতে গত ১৩ জুন লিখিত অভিযোগ দেন।
সর্বশেষ, গতকাল আইনজীবী সহকারী কাদেরসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেছেন যশোর শহরের বারান্দিপাড়া কদমতলার মৃত ওলিউল্লার ছেলে ইমরান হোসেন বকুল। তার অভিযোগ আইনজীবী সহকারী কাদেরসহ বাঘারপাড়া উপজেলার ইন্দ্রাগ্রামের জেসমিন, তার স্বামী মেহেদী হাসান শাহিন, ওমর ফারুক, লিটন হোসেন, ঠাকুরগাতি গ্রামের রেবেকা খাতুন ও যশোর সদর উপজেলার বাগডাঙ্গা গ্রামের রফিকুল ইসলাম তুহিন জাল দলিল ও কাবিননামা সৃষ্টি করে প্রায় অর্ধকোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। আদালত অভিযোগ আমলে নিয়ে পিবিআইকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দিয়েছেন।
এছাড়া,গত কয়েক মাস আসে ইব্রাহিম নামে এক আইনজীবী সহকারী অস্ত্রসহ ডিবির হাতে আটক হন। আরেক আইনজীবী সহকারী সদর কোর্ট জিআরও অফিস থেকে মামলার আলামত চুরি করতে গিয়ে পুলিশের কাছে ধরা পড়েন। এখন তারা প্রকাশেই আদালতে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
গত কয়েকদিনের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে,আইনজীবী সহকারী আব্দুল কাদের, সুজিদ, চয়ন, রাকিব হোসেন, হাসানসহ আরও ১৫-২০ জনকে যত্রতত্র আদালত চত্বরে ঘোরাঘুরি করছে। তারা ব্যবহার করছে না নির্ধারিত ড্রেস ও আইডি কার্ড। কাদেরসহ আরও কয়েক আইনজীবী সহকারীরও একাধিক ‘সহকারী’। তাদের অনেকেই সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে লিপ্ত।
তাদের আচরণে বোঝার উপায় নেই কে আইনজীবী, কে আইনজীবী সহকারী, কে আসামি, কে প্রতারক আর কে বিচারপ্রার্থী।
অপরদিকে, আদালত চত্বরের টাউট হিসেবে পরিচিত ইদ্রিস আলমকে অবাঞ্চিত ঘোষণা করা হলেও আইনজীবী সমিতির ১ নম্বর ভবনের পাশেই বিশাল অফিস নিয়ে বসেছেন। তিনি নিজে আদালত চত্বরে না গেলেও তার দু’ সহকারী নাইম ও মোমিনকে প্রতিদিনই পাঠাচ্ছেন। এভাবে তার প্রতারণামূলক কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন বলে জানিয়েছেন অন্তত ২০ জন আইনজীবী। এই ইদ্রিস আলম প্রধান ডাকঘরের সামনে একটি অখ্যাত পত্রিকার সাইনবোর্ড ঝুলানো অফিসে বসেও নানা প্রতারণা করছেন বলে একাধিক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেছেন।
এ বিষয়ে আইনজীবী সহকারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক সিরাজুল ইসলাম বলেন, তারা প্রতিনিয়ত এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখেন। ইতিমধ্যে নানা অভিযোগে অভিযুক্ত আইনজীবী সহকারীদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। দ্রুতই আইনজীবী সমিতিকে অবহিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শাহানুর আলম শাহীন বলেন, তারা ইতিমধ্যে কয়েকজন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছেন। আরও কয়েকজনকে নজরে রেখেছেন।