
মধ্য আমেরিকার সবচেয়ে জনবহুল রাষ্ট্র গুয়াতেমালা। পাহাড়, আগ্নেয়গিরি, সমুদ্র, হ্রদ, ঘন অরণ্যে বেষ্টিত এই অঞ্চল। গুয়াতেমালার একটি চিরহরিৎ অরণ্যের তলায় খোঁজ মিলল দু’হাজার বছরের পুরনো এক প্রাচীন নগরের। কথিত রয়েছে, মেক্সিকোর সীমান্তে গুয়াতেমালার একাধিক জায়গায় গড়ে উঠেছিল মায়া সভ্যতা। সম্প্রতি এই মায়া সভ্যতার একটি নগরের ধ্বংসাবশেষ মিলল।
প্রত্নতত্ত্ববিদেরা লিডার প্রযুক্তির সাহায্যে পাখির চোখ দেখে প্রাচীন নগরের সন্ধান পেয়েছেন। লিডার প্রযুক্তি বলতে ‘লাইট ডিটেকশন অ্যান্ড রেঞ্জিং’ প্রযুক্তিকে বোঝানো হয়। আমেরিকার বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞ ছাড়াও ফ্রান্স এবং গুয়াতেমালার কয়েক জন স্থানীয় গবেষকরা এই প্রাচীন নগর আবিষ্কারের নেপথ্যে রয়েছেন।
গবেষকদের বক্তব্য, মেক্সিকোর সীমান্তে মিরাডর-কালাকমুল কার্স্ট অববাহিকা অঞ্চলের একটি চিরহরিৎ অরণ্যের তলায় প্রায় ১,৭০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে এই নগরের অবস্থান ছিল।
প্রতœতত্ত্ববিদেরা জানান যে, এই প্রাচীন নগর মায়া সভ্যতার ইতিহাস বহন করছে। দু’হাজার বছর আগে এই নগরের অস্তিত্ব ছিল। হাজারের কাছাকাছি জনবসতি এই নগরে গড়ে উঠেছিল বলে জানান প্রত্নতত্ত্ববিদেরা।
হাজারটি জনবসতির মধ্যে প্রতিটি একে অপরের সঙ্গে উঁচু এবং বাঁধানো রাস্তা দিয়ে যুক্ত। নগরের ভিতর প্রায় ১৬০ কিলোমিটার জুড়ে রাস্তাগুলি ছড়িয়ে রয়েছে।
প্রতœতত্ত্ববিদদের ধারণা, নগরের অধিবাসীদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য নগর জুড়ে রাস্তাগুলি এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, খুব সহজেই নগরের যে কোনও প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া যায়।
মায়া সভ্যতার এই প্রাচীন নগরে পানি সংরক্ষণের সুব্যবস্থা ছিল বলে প্রতœতত্ত্ববিদেরা জানিয়েছেন। নগরের ধ্বংসাবশেষ থেকে তার প্রমাণও পেয়েছেন তারা। নগরের অধিকাংশ জায়গায় জল সংরক্ষণের জন্য আলাদা জায়গা ছিল বলে জানান প্রতœতত্ত্ববিদেরা।
এমনকি, নগর জুড়ে বহু খালও ছিল বলে মন্তব্য করেন তারা। শুষ্ক আবহাওয়া থাকলে জলের অভাব দেখা দিত এই নগরে। তখন পানির প্রয়োজন মেটানোর জন্য সংরক্ষণ ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন অধিবাসীরা।
মায়া সভ্যতার প্রাচীন নগরের বিভিন্ন জায়গায় পিরামিডের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছেন প্রতœতত্ত্ববিদেরা। এমনকি, নগরের বেশ কিছু জায়গায় উঁচু জায়গার মতো লক্ষ করেছেন তারা।
তবে, জায়গায় জায়গায় এমন উঁচু মঞ্চের মতো অংশ কী উদ্দেশে ব্যবহার করা হত, তা নিয়ে এখনও চূড়ান্ত ভাবে কিছু জানাননি প্রতœতত্ত্ববিদেরা।
প্রাচীন নগরীর অধিবাসীরা রাজনীতি নিয়ে আলোচনা করার জন্য এক জায়গায় জড়ো হতেন বলে অনুমান। এমনকি, বিনোদনমূলক কোনও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে নগরের সকলে সমবেত হতেন বলে অনুমান প্রত্নতত্ত্ববিদদের।
নগরের কয়েকটি বাড়ির সামনে উন্মুক্ত জায়গা লক্ষ করেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা। তাদের প্রাথমিক অনুমান, নগরের অধিবাসীরা কোনও বিশেষ ধরনের খেলার জন্য এই মাঠের ব্যবহার করতেন।
তবে এই প্রাচীন নগরের খোঁজ পেতে গবেষকরা রাডারের পরিবর্তে লিডার প্রযুক্তির ব্যবহার কেন করলেন? লিডার প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে কোনও বিশেষ সুবিধা পাওয়া গেল কি? ‘অ্যানসিয়েন্ট মেসোআমেরিকা’ নামে একটি গবেষণা পত্রিকায় প্রকাশ পেয়েছিল লিডার প্রযুক্তির খুঁটিনাটি।
রেডিয়ো তরঙ্গের পরিবর্তে লিডার প্রযুক্তিতে লেজার রশ্মি ব্যবহার করা হয়। লেজারের মাধ্যমে অরণ্যের গভীর আস্তরণ ভেদ করা যায়। মাটির তলায় কোনও ধ্বংসাবশেষ থাকলে তার স্পষ্ট ছবি ধরা পড়ে লিডার প্রযুক্তির মাধ্যমে।
গবেষকরা বিমানের মধ্যে থেকে নির্দিষ্ট এলাকার উপর লেজার রশ্মি ফেলে পরীক্ষা করেছিলেন। রশ্মি ফেলার পর নগরের প্রতিটি রাস্তাঘাটের বাঁক থেকে শুরু করে ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষের ছবি ধরা পড়ে। এর ফলে মায়া সভ্যতার বিষয়ে আরও বিশদে জানা যাবে।
পুরনো তথ্য ঘাঁটলে দেখা যায় যে, মায়া সভ্যতার অধিবাসীরা কোথাও বসবাস করলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকতে পছন্দ করতেন। কিন্তু এই নগরের অধিবাসীদের আচরণ ভিন্ন। তারা এক জায়গায় জটলা করে বসতি গড়ে তুলতেন বলেই জানা যায়। প্রাচীন নগরের এই সন্ধান পাওয়ার ফলে তা মায়া সভ্যতার রাজনীতি, সামাজিক অবস্থা এবং বসতির গঠন সম্পর্কে কোনও নতুন পথের খোঁজ দিতে পারছে কি না, তা নিয়ে গবেষণা চলছে।