
কওমি মাদ্রাসাগুলোর সর্বোচ্চ সংস্থা আলহাইয়াতুল উলইয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়্যাহর ওয়েবসাইট থেকে জানা যাচ্ছে গত ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ১ হাজার ৬৮০টি মাদ্রাসা থেকে অন্তত ২৪ হাজার ৯৩২ জন শিক্ষার্থী দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স সমমান) পরীক্ষা দিয়েছেন। ওয়েবসাইটে প্রাপ্ত মোবাইল নম্বরে ফোন দিলে সংস্থাটির অফিস থেকে একজন জানালেন, আগামী শিক্ষাবর্ষে দাওরায়ে হাদিসের পরীক্ষায় সর্বমোট প্রায় ২ হাজার ২০০ মাদ্রাসা নতুন করে নিবন্ধিত হয়েছে। সুতরাং বলা বাহুল্য গত বর্ষের তুলনায় আসন্ন কেন্দ্রীয় পরীক্ষায় শিক্ষার্থী সংখ্যা বেশ বাড়বে। এছাড়া এখনও সারা দেশে কিছু মাদ্রাসা নিবন্ধনের বাইরে রয়েছে।
কওমি মাদরাসার শিক্ষাব্যবস্থাটা সাজানো ধর্মীয় বিষয়াদির ওপর ভিত্তি করে। যদিও এখানে সাধারণ সব বিষয়ই অল্পবিস্তর পাঠদান করা হয়, তবে সেটা নিতান্তই আনুষ্ঠানিক। এই বিষয়টি তারাও স্বীকার করেন এবং নিজেদের তারা ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচয় দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। এখানে পড়াশোনা শেষে একজন শিক্ষার্থী ইসলামি ফিকহ (আইন শাস্ত্র), তাফসির ও হাদিস বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান লাভ করেন। একইসঙ্গে মাতৃভাষার পাশাপাশি তারা সুন্দর আরবি, উর্দু এবং অনেকে ফার্সি ভাষাটাও ভালোভাবে রপ্ত করতে পারেন।
সরকারও সিলেবাস বিবেচনা করে কওমি মাদরাসার দাওরায়ে হাদিসকে ‘ইসলামি শিক্ষা ও আরবি সাহিত্য’র ওপর মাস্টার্সের সমমানে স্বীকৃতি দিয়েছে। বেশ কয়েকটি ধাপ অতিক্রমের পর ২০১৮ সালের ৮ অক্টোবর এই স্বীকৃতির চূড়ান্ত আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। এর ফলস্বরূপ সরকার কওমি আলেমদের থেকে বিশেষ ‘শুকরিয়া’ও গ্রহণ করেছে। কিন্তু এই স্বীকৃতির বাস্তবিক কার্যকারিতা এখনও দৃশ্যমান নয়।
উপরোল্লিখিত বর্ণনা থেকে অনুমান করা যায় যে– প্রতিবছর আসলে কত সংখ্যক আলেম পড়ালেখা শেষ করে কর্মক্ষেত্রে পদার্পণের উপযুক্ত হচ্ছেন এবং তাদের কর্মক্ষেত্রই বা কী? সাদাসিধে ও সংক্ষিপ্ত জবাব হচ্ছে– ধর্মীয় সকল সেক্টর ও আরবি-উর্দু ভাষা পাঠদানই তাদের জন্য প্রধান ও উপযুক্ত কর্মক্ষেত্র। কিন্তু দেখার বিষয় হলো– প্রতিবছর যে সংখ্যক আলেম কর্মের জন্য তৈরি হচ্ছেন, সে অনুযায়ী কর্মক্ষেত্র আছে কিনা কিংবা কর্মী বৃদ্ধির মতো নতুন নতুন কর্মসংস্থানও সৃষ্টি হচ্ছে কি না?
এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলাম আলহাইয়াতুল উলইয়া লিল-জামিয়াতিল কওমিয়্যাহর স্থায়ী কমিটির সদস্য মুফতি মোহাম্মদ আলির কাছে। প্রথমেই তিনি কওমি আলেমদের কর্মসংস্থানের অপ্রতুলতার কথা অস্বীকার করলেন। তিনি বললেন, কওমি মাদ্রাসা পড়ুয়াদের কর্মসংস্থানের অভাব—এই দাবিটি অবাস্তব। বর্তমান পরিস্থিতিতে আরও অনেক সংখ্যক যোগ্য আলেম দরকার। দেশের বিভিন্ন এলাকায় প্রয়োজন অনুযায়ী মসজিদ-মাদরাসা এখনও গড়ে ওঠেনি। মুসলমানদের যতটুকু ধর্মীয় শিক্ষা প্রয়োজন, তা পূরণ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আরও অনেক মসজিদ-মাদ্রাসা গড়ে তোলা দরকার। আর এজন্য আরও বেশি যোগ্য আলেম তৈরি হতে হবে।
তবে আলেম হওয়ার পরও যারা সাংবাদিকতা, ফ্রিল্যান্সিং, ব্যবসা ইত্যাদি পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। তাদের সাধুবাদ দিলেন মুফতি মোহাম্মদ আলি। তার মতে, সাধারণ সেক্টরগুলোতেও যদি আলেমদের পদচারণা বৃদ্ধি পায়, তাহলে সেসব সেক্টরেও সততা ও ইনসাফ ফুটে ওঠবে। কিন্তু কওমি আলেমদের উপযোগী কর্মসংস্থানের স্বল্পতার কারণ দেখিয়ে যারা এমন পেশা বেছে নেন, তাদের বোধগম্য সঠিক নয়।
ইদানীং কিছু নবীন আলেমকে দেখা যায়, তারা মসজিদ-মাদ্রাসা সংশ্লিষ্ট খেদমত (পেশা) নিয়ে সন্তুষ্ট নন। মানে এসব প্রতিষ্ঠানে যে হাদিয়া (বেতন) তারা পান, তা দিয়ে সমাজে একটু ‘ভালোভাবে’ চলা কষ্টকর হয়ে পড়ে। এজন্য তারা মাদ্রাসা-মসজিদের বদলে কর্মক্ষেত্র হিসেবে বিকল্প কিছু গ্রহণ করেন। তাদের ব্যাপারে মুফতি মোহাম্মদ আলি বলেন, এটি তাদের একান্ত ব্যক্তিগত সমস্যা। সঠিক তালিম-তারবিয়াতের (দিকনির্দেশনা) অভাবে এমনটি হয়। আমরা আমাদের পূর্বসূরি ও সাহাবা-তাবেঈনদের জীবনে দেখি– পৃথিবীটা একেবারেই ক্ষণস্থায়ী। এর জন্য খুব প্রচেষ্টা তারা করেননি; বরং তারা দুনিয়া বিমুখ ছিলেন, আখিরাতকে প্রাধান্য দিতেন। এই তারবিয়াত যদি আমরা পাই, তাহলে এই স্বল্প বেতনও মোটামুটিভাবে জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট। তবে শর্ত হলো- ইসলামের মৌলিক শিক্ষা পেতে হবে এবং নিজেদের মধ্যে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের মেজাজ প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
গত ২৯ ডিসেম্বর ভারতের প্রখ্যাত আলেম, অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও ইসলামি ফিকহ একাডেমি-ভারতের সাধারণ সম্পাদক মুফতি খালেদ সাইফুল্লাহ রাহমানি এ সংক্রান্ত দুই পর্বের একটি দীর্ঘ কলাম লিখেন। সেখানে তার মতামতটিও মুফতি মোহাম্মদ আলির মতের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। মুফতি রাহমানির অভিমতটি প্রায় এমন– অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের মাদ্রাসায় পড়ানোর আগে তাদের ভবিষ্যৎ কী হবে, সেটি সম্পর্কে অভিভাবকদের জানা দরকার
। আর নবীন আলেমদেরও বুঝেশুনে দ্বীনি খেদমতে পদার্পণ করা উচিৎ। তাদের সামনে তাদের পূর্বসূরিদের জীবন ও অভিজ্ঞতা রয়েছে। যদি নবীনরা পূর্বসূরিদের ত্যাগ ও কোরবানি মেনে নিতে পারেন, তাহলেই তারা এখানে আসবেন।
মুফতি খালেদ সাইফুল্লাহ রাহমানি লেখেন, যদি নবীনরা মনে করেন, তারা পূর্ববর্তীদের মতো ত্যাগ মেনে নিতে পারবেন না, তাহলে উপার্জনের জন্য তাদের অন্য কোনও (হালাল) পন্থা অবলম্বন করা উচিৎ এবং তার পাশাপাশি সামর্থ্য অনুযায়ী তারা দ্বীনি খেদমতে সময় দিতে পারেন। কেননা, আলেম হওয়ার পর মসজিদ-মাদ্রাসায় খেদমত করা কোনও জরুরি বিষয় নয়। নিজের মর্জিতে দ্বীনি খেদমত বেছে নেওয়া এবং পরবর্তীকালে ফের এই খেদমতে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করা ও অন্যের কাছে অভিযোগ করা কোনও গ্রহণযোগ্য বিষয় নয়। কারণ, এতে সামগ্রিকভাবে আলেম সমাজের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হয়।
বরং আলেমরা তাদের উপযোগী খেদমতের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যবসা ও কারিগরি কাজও করতে পারেন বলে মনে করেন মুফতি খালেদ সাইফুল্লাহ রাহমানি। তার মতে- এটি করলে তাদের অর্থনীতির সঙ্কট কেটে যাবে এবং জীবনযাপন আরও সমৃদ্ধ হবে। এ বিষয়ে তিনি লেখেন, আমাদের পূর্ববর্তীদের মধ্যে দ্বীনি খেদমতের পাশাপাশি উপার্জনের জন্য ভিন্ন পথ অবলম্বনের বেশ উদাহরণ রয়েছে। ইমাম কুদুরি (রহ.)-এর মতো বিদগ্ধ ফকিহ হাঁড়ি-পাতিল বানানোর কাজ করেছেন, ইমাম আবু বকর জাসসাস (রহ.) চুন বিকিকিনি করতেন, ইমামে আজম আবু হানিফা (রহ.) রেশমী কাপড়ের ব্যবসা করতেন। এরচেয়ে যদি ওপরে যাই, তাহলে হজরত আবু বকর, হজরত ওমর, হজরত ওসমান এবং হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ (রা.)-এর মতো বড় বড় সাহাবি ব্যবসায়ী ছিলেন। এদের ওপরে গেলে বহু নবী-রাসুল (আ.)-ও ব্যবসা ও নানা কারিগরি কাজ করতেন। হজরত আদম (আ.) ছিলেন কৃষক, হজরত ইদরিস (আ.) সেলাইকাজ ও হজরত দাউদ (আ.) কামারের কাজ করেছেন। আর সংক্ষেপে বললে- বেশিরভাগ নবী-রাসুল (আ.) পশু পালন করেছেন। হাদিস শরিফে এসেছে, ‘আল্লাহতায়ালা পেশাজীবী মুমিনকে পছন্দ করেন।’ (আত তারগিব ওয়াত তারহিব, হাদিস : ২৩৩৫)
তবে আমাদের সমাজে আলেমদের ভিন্ন পেশা গ্রহণকে এখনও স্বাভাবিক দৃষ্টিতে দেখার প্রচলন শুরু হয়নি বলে অনেকে মনে করেন; বরং যারা মসজিদ-মাদ্রাসার বাইরে ভিন্ন কোনও কাজকে পেশা হিসেবে নেন, তাদের দিকে আড়চোখে তাকানো হয়। তবে বিষয়টির বিরোধিতা করেছেন মুফতি মোহাম্মদ আলি। তিনি দাবি করেন, ভিন্ন পেশা গ্রহণকারী আলেমদের আড়চোখে দেখার কারণ কখনওই এটি নয় যে, তারা মসজিদ-মাদ্রাসার বাইরে আছেন; বরং তাদের যদি কখনও আড়চোখে দেখাই হয়, তাহলে সেটি হলো, তাদের জীবনযাপনে পরিবর্তন আসার কারণে। মানে তারা ভিন্ন পেশা গ্রহণের পর লেবাস-পোশাকে, চলা-ফেরায়, জীবনযাপনে ধর্মীয় অনুশাসন থেকে বেরিয়ে যান কিংবা তাদের জীবনে ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব পরিলক্ষিত হওয়ার কারণে এমনটি হয়।
উপরের দুই আলেমের বক্তব্য সম্পূর্ণ সমর্থন করেন তরুণ আলেম ও সাংবাদিক মুফতি তানজিল আমির। তবে তিনি মনে করেন, সরকার যদি দাওরায়ে হাদিসের স্বীকৃতির বাস্তবায়ন ঘটায়—মানে কওমি আলেমরা যদি তাদের যোগ্যতা অনুসারে বিদ্যালয়গুলোতে ধর্মীয় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান, কওমি শিক্ষার্থীদের বিদেশে পড়াশোনার অনুমোদন দেওয়া হয় এবং দাওরায়ে হাদিসের স্বীকৃতি সংশ্লিষ্ট তাদের যৌক্তিক দাবিগুলো মেনে নেওয়া হয়, তাহলে যেমন তাদের নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে এবং অপরদিকে, এতে সাধারণ শিক্ষার্থীরাও ইসলামের সহি শিক্ষাটা লাভ করতে পারবে।
জানা আছে যে কওমি মাদ্রাসার শুধু দাওরায়ে হাদিসের স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে, এর নিচের শ্রেণিগুলোর কোনও স্বীকৃতি নেই। এটির জন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধু দাওরায়ে হাদিসের সনদ কাজে লাগানো যাচ্ছে না বলে অনেকে মনে করেন। এ বিষয়ে একটি ঝুঁকিমুক্ত পরামর্শ দিয়েছেন তরুণ আলেম তানজিল আমির।
তার মতে- দাওরায়ে হাদিসের নিচের শ্রেণিগুলোকে স্বীকৃতির আওতায় আনতে নতুন করে কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। ২০১৩ সালে কওমি মাদ্রাসাগুলোর সব মতের শীর্ষ আলেমদের সমন্বয়ে গঠিত কওমি কমিশনের সুপারিশকৃত সিলেবাসটি কার্যকর করেই পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে স্বীকৃতির আওতায় আনা যায়। এটি অধিকতর নিরাপদ ও ঝুঁকিমুক্ত একটি পদক্ষেপ হতে পারে। কারণ, আল্লামা আহমদ শফীর সভাপতিত্বে বিদগ্ধ ও বর্ষীয়ান আলেম মাওলানা সুলতান যওক নদবীসহ সব বোর্ডের শীর্ষ আলেমরা তখন পুরো শিক্ষাব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে ওই সিলেবাসটি রচনা করেছিলেন। যদিও পরে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে স্বীকৃতির কার্যক্রম থেমে যাওয়ায় কওমি কমিশনের কাজ থমকে যায়। কিন্তু সেসময় আলেমদের দীর্ঘ গবেষণা ও চূড়ান্ত মতের ভিত্তিতে গঠিত এ সিলেবাস কার্যকর করলেই স্বকীয়তা রক্ষা করেই পুরো কওমি শিক্ষাব্যবস্থাকে স্বীকৃতির আওতায় আনা একটি সহজ সমাধান হতে পারে। এতে কওমি মাদ্রাসার বিরাট একটি জনগোষ্ঠী যেমন বেশ উপকৃত হবে এবং তাদের কাছে সরকারের ভাবমূর্তিও উজ্জ্বল হবে। যেমনটি হয়েছিল স্বীকৃতি দেওয়ার পর।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী; শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ, ঢাকা।