
‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে’ স্লোগানে ১৯৯৯ সালের ৪, ৫ ও ৬ মার্চ যশোর টাউন হল ময়দানে বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলন অনুষ্টিত হয়। তিনদিনব্যাপী সম্মেলনে যশোরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের উপস্থিতি এবং বর্ণিল সাজে যশোর শহর যেন আলোকিত হয়ে উঠেছিল। দেশের প্রখ্যাত সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বমসহ অন্যান্য গুণীজন এবং সংগঠনের সারা দেশের প্রতিনিধির উপস্থিতি ও আলোচনায় প্রাণ সঞ্চার হয়ে ওঠে। সম্মেলন উপলক্ষ্যে প্রতিদিন রাতে টাউনহল ময়দানে দেশের বিশিষ্ট শিল্পী ও ভারতীয় সাংস্কৃতিক সংগঠন ও শিল্পীদের গান পরিবেশনায় কানায় কানায় পূর্ণ দর্শকশ্রোতা মুগ্ধ থাকতো।
সম্মেলনের শেষদিন অর্থাৎ ৬ মার্চ রাত ১টা ১৫ মিনিটে হিংস্র দানব, নরপিশাচদের হীন উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে পুতে রাখা শক্তিশালী দুটি বোমা রিমোর্ট কন্ট্রোলের মাধ্যমে বিষ্ফোরণে নাজমুল হুদা তপন, সন্ধারাণী ঘোষ, নুর ইসলাম, ইলিয়াস মুন্সি, বাবুল সুত্রধর, শাহ আলম মিলন, মোহাম্মদ বুলু, রতন কুমার বিশ^াস, শাহা আলম পিন্টু, বাবুরাম কৃষ্ণ শহীদ হন। এই বোমা হামলায় আরও দুই শতাধিক মানুষ মারাত্মকভাবে গুরুতর জখম হন। সৃষ্টি হয় বিভৎস বিভিষিকাময় পরিবেশ। এই কাপুরুষোচিত ঘটনায় যশোরসহ সারা দেশের মানুষ বিস্মিত হয়ে পড়ে, সান্তনার ভাষা হারিয়ে ফেলে। পৃথিবীর ইতিহাসে সভ্য দেশে প্রথম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করে মানুষ হত্যার নজির সৃষ্টি হলো বাংলাদেশে।
রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় তখন আওয়ামী লীগ সরকার। যশোর কোতয়ালি থানার তৎকালীন এসআই আব্দুল আজিজ উদীচীর সমাবেশে বোমা হামলা এবং হত্যা সংক্রান্তে পরের দিন ৭ মার্চ কোতয়ালি থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলাটি তদন্ত শেষে সিআইডি যশোরের তৎকালীন এএসপি দুলাল উদ্দীন আকন্দ তদন্ত শেষে ৩২৪, ৩২৬, ৩০৭, ৩০২/৩৪ দঃবিঃ এবং বোমা বিষ্ফোরক দ্রব্য আইনে ৩, ৪ ও ৬ ধারায় ওই বছরের ১৪ ডিসেম্বর অভিযোগপত্র দাখিল দাখিল করেন আদালতে। এতে আসামি করা হয় ২৪ জনকে। বিচারে জেলা যশোরের বিজ্ঞ স্পেশাল সেশন জজ মো. আবুল হোসেন ব্যাপারি ২০০৬ সালে ২৮ জুন সকল আসামিকে খালাস প্রদান করে রায় ঘোষণা করেন। রায় ঘোষণাকালে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার।
মামলাটি শুরু থেকে অর্থাৎ তদন্ত, বিচার পর্যন্ত চলে প্রহসনের নাটক। রাজনীতির ষড়যন্ত্রের শিকারে আলোচিত উদীচী হত্যাকান্ড বিচারের গতিপথ নষ্ট করে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সরকার। সভা-সমাবেশ, স্বাধীন মত প্রকাশ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করা এবং যোগদান যে কোন ব্যক্তি বা সংগঠনের সাংবিধানিক মৌলিক অধিকার; যেটা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৭, ৩৯ অনুচ্ছেদে সুস্পষ্ট লিপিবদ্ধ আছে। অপরদিকে রাষ্ট্র জনগণের জান-মালের নিরাপত্তা বিধান প্রদানে বাধ্য। ১৯৯৯ সালে ৬ মার্চে উদীচীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নিরাপত্তা বিধানে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। নৃসংশ বোমা হামলায় আহতরা আজও দুর্বিসহ জীবন পার করছে। পরিবার পরিজন এমনকী স্বজনের কাছে বোঝা হয়ে পড়েছেন। পঙ্গুতের অভিশাপ নিয়ে অনেকেই চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত এবং কর্মহীন মানুষ হিসেবে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। এক্ষেত্রে সব সরকার নির্বিকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছে।
সংবিধানের ৩১ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের প্রত্যেক নাগরিক যে কোন স্থানে অবস্থানরত অবস্থায় আইনের আশ্রয় লাভের অধিকার রাখে। উদীচী হত্যাকান্ড ২৪ বছর পার হলেও আজও হত্যাকারীর বিচার হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে এসএম সোলাইমান সলিসিটর (ভারপ্রাপ্ত) ২০১০ সালে ফৌঃ কাঃ ৪১৭ ধারায় উদীচী হত্যাকান্ডের যশোরের সেশন জজের ২৮/০৬/০৬ সালের খালাসের বিরুদ্ধে মহামান্য হাইকোর্টে আপিল দাখিল করেন। যা রুল নং ২০৬/১০ এবং ক্রিঃ আঃ নং ২/১১। মহামান্য হাইকোর্ট ০৪/০৫/১১ তারিখের আদেশে খালাসপ্রাপ্ত আসামিদের সংশ্লিষ্ট আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ প্রদান করার পর পরবর্তীতে উদীচী হত্যাকান্ডের বিচার সংক্রান্তে কার্যক্রম অনুপস্থিত এবং ইতিহাসের এই নৃসংশতম ঘটনার বিচার হিমাগারে আটকে আছে।
উদীচী বাংগালি সংস্কৃতির পক্ষে, সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদ, সৈ¦রাচার, সামাজিক অনাচার, শোষণ, লুটপাটের বিরুদ্ধে গণমানুষের সাংস্কৃতিক জাগরণের উচ্চারিত নাম। মুক্তিয্দ্ধুসহ মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী স্বাধীন দেশের ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে উদীচীর রয়েছে রক্তমাখা গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। দীর্ঘ ২৪ বছরে যশোর টাউনহল মাঠে উদীচীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ফ্যাসিস্ট শক্তির বোমা হামলার বিচার না হওয়ায় রাষ্ট্র দায়মুক্ত হতে পারে না। সরকারকে কলঙ্কজনক ঘটনার মামলার নিরপেক্ষ পুনঃতদন্ত, দোষীদের গ্রেপ্তার করে সুষ্ট বিচার, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি ও পরিবারের আর্থিক সহায়তা অব্যাহত রাখতে হবে এবং এই নারকীয় ঘটনার নেপথ্যের কুশিলবদের শনাক্ত করতে হবে।