
দেশের সামুদ্রিক জলসীমায় মাছের সুষ্টু প্রজনন, জলসীমায় মাছের বংশবিস্তার বাড়াতে মাছ ধরার ওপর ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ২০ মে থেকে ২৩ জুলাই পর্যন্ত এ নিষেধাজ্ঞা থাকবে। নিষেধাজ্ঞার আসায় সমুদ্রগামী লাখো জেলের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে কিন্তু কখনও মাছ ধরা তো দূরের কথা, সমুদ্রে যায়নি। অথচ তারাও সরকারের দেয়া বিশেষ খাদ্য সহায়তার চাল নিয়ে যাচ্ছে। এদের সংখ্য অন্তত তিন হাজার। কারও কারও মতে, পাঁচ হাজার হবে। কিন্তু সমুদ্রগামী শত শত প্রকৃত জেলেরা চাল পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে একদিকে সরকারের আড়াই শ’ মেট্রিক টন চাল অপেশাধারী এক শ্রেণির লোকজন জেলে পরিচয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে।
তারা কৌশলে জেলে পরিচয়পত্র পর্যন্ত বানিয়ে নিয়েছে। যেন অরাজক পরিস্থিতি চলছে। উপজেলা প্রশাসন থেকে প্রকৃত জেলেদেরকে চাল বিতরণের স্বার্থে তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের জন্য বহু আগে জনপ্রতিনিধিদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। কিন্তু তা বাস্তবায়নে চলছে ধীরগতি।
কলাপাড়া উপজেলা মৎস্য অফিসের দেয়া তথ্যানুসারে কার্ডধারী সমুদ্রগামী জেলেদের সংখ্য ১৮ হাজার ৩০৫ জন। সমুদ্রে ৪৭৫ প্রজাতির মাছের নিরাপদ প্রজনন ও বংশবৃদ্ধির লক্ষ্যে ২০ মে থেকে শুরু হওয়া ৬৫ দিনের মাছ ধরার নিষেধাজ্ঞা চলছে। ফলে বেকার হওয়া জেলে পরিবারের জন্য সরকারি উদ্যোগে ইতোমধ্যে প্রথম কিস্তির ৫৬ কেজি চাল বিতরণ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। বাকি ৩০ কেজি পরে দেয়া হবে। কিন্তু সমুদ্রগামী প্র কৃত জেলেদের স্বচ্ছ কোন তালিকা না থাকায় জেলেদের চাল চলে যাচ্ছে অপেশাধারী মানুষের কাছে। আর শত শত প্রকৃত জেলে বঞ্চিত থাকছে চাল পাওয়া থেকে।
জেলেরা বলছেন, বছরের ৬৫ দিনের মধ্যে বিভিন্ন ধাপে ১৪৭ দিন নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ায় লাখো জেলে ও ব্যবসায়ীর মেরুদন্ড ভেঙ্গে গেছে। জেলেরা যে সরকারি সহায়তা পান, তা অপ্রতুল। ফলে তাদের জীবন কাটে চরম দুর্দশায় মা ইলিশ ধরায় ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা, মার্চ- এপ্রিল ৬০দিনের অভয়াশ্রমের শেষ হতে না হতেই আবার ৬৫ দিনের নিষেধাজ্ঞা নিয়ে তারা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
গঙ্গামতি গ্রামে আলী হোসেন বলেন, আমাদের জেলেদের কার্ড আছে কিন্তু আমরা ঠিকমত চাল পাচ্ছে না। চালে নামে কার্ড অপেশাধারিদের নাম। শুধু জীবিকার তাগিদেই নয় প্রতি মূহুর্তে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মাছ শিকার করে অর্থনীতির চাকা সচল করছেন পেশাদার জেলেরা। উওাল সাগর ও বন্যার সময় জীবন যুদ্ধে হার না মানা এসব সাহসী আতœনির্ভরশীল মানুষগুলো নির্ধারিত সময়ে কাঙ্খিত মৎস্য আহরনের লক্ষ্যে ছুটে যায় গভীর সমুদ্রসহ বিভিন্ন নদ-নদীতে। এ সময় উওাল সাগরে ট্রলার ডুবে গেলে কারো কারো খোঁজ স্বজনেরা পেলেও অনেকেরই সলিল সমাধি হয়েছে সাগরে। আর এসব জেলেদের মৎস্য শিকারে নিষেধাজ্ঞাকালীন সময়ে সরকারী ভাবে তালিকা প্রনয়নের মাধ্যমে বিশেষ প্রনোদনা (ভিজিএফ) এর আওতায় আনলেও হালনাগাদ তালিকার ফাঁদে পড়ে সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছেন পেশাদার জেলেরা।
মহিপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও মৎস্য ব্যবসায়ী সমতির সাবেক সভাপতি গাজী ফজলুর রহমান জানান, কলাপাড়ায় প্রায় পাঁচ শ’ ফিশিং বোট রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় তিন শ’ বড় বোট। যেখানে প্রত্যেক বোটে ২০-২২ জন জেলে রয়েছে। আর ছোট ইঞ্জিনচালিত বোট রয়েছে আরও দুই শ’। তারাও সাগরের গভীর অগভীর এলাকায় ফিশিং করে। এসব বোটে গড়ে ১০-১২ জন জেলে থাকেন।
এছাড়া কুয়াকাটা থেকে কাউয়ারচর পর্যন্ত কমপক্ষে এক হাজার খুটা জেলের বোট রয়েছে। এই বোটে গড়ে ৪-৫ জন জেলে কাজ করেন। এই হিসেবে সমুদ্রের কলাপাড়া এলাকায় গভীর-অগভীর এবং সাগর কিনারে মাছ ধরেন সর্বোচ্চ ১৪ হাজার জেলে। অথচ সমুদ্রগামী জেলেদের চাল বরাদ্দ রয়েছে ১৮ সহ¯্রাধিক।
ইউপি চেয়ারম্যান ফজলু গাজী আরও জানান, বর্তমানে প্রকৃত জেলেদের তালিকা যাচাই-বাছাই করার কাজ চলছে। এর খসড়া তালিকা প্রকাশ্যে ঝোলানো হবে। তাইলে সমস্যা মিটে যাবে। তার ধারণা যাচাই-বাছাই করলে তার ইউনিয়নে কমপক্ষে চার শ’ নাম বাদ পড়বে। আবার সমানসংখ্যক প্রকৃত জেলের নাম অন্তর্ভুক্ত হবে।
ধুলাসার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হাফেজ আব্দুর রহমান বলেন, আমার ইউনিয়নে বর্তমানে ১৭৪৮ জন জেলের নাম তালিকাভুক্ত রয়েছে। অনেক আগের তালিকা এটি। যা মধ্যে অনেকে মারা গেছেন। অনেকে এলাকা ছেড়েছেন। আবার অনেক হোন্ডা ড্রাইভারের নাম আছে তালিকায়। এখন যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শেষের দিকে। তাতে পাঁচ শ’ নাম বাদ পড়তে পারে। তবে প্রকৃত জেলেরা তালিকায় আসলে সরকারের উদ্যোগ সফল হবে।
কলাপাড়া উপজেলা ফিশিং ট্রলার মাঝি সমিতির সভাপতি নুরু মাঝি জানান, সঠিকভাবে জেলে তালিকা যাচাই-বাছাই করলে বর্তমান তালিকার ৪০ ভাগ বাদ পড়বে। তবে আবার প্রকৃত জেলেরা তালিকায় আসবে।
কলাপাড়া উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা বলেন, প্রকৃত জেলেদের তালিকা তৈরির কাজ চলছে। এক্ষেত্রে খসড়া তালিকা তৈরির কাজ শেষ পর্যায়ে। পাঁচটি ইউনিয়নের খসড়া তালিকায় অন্তত ২০০ নাম বাতিলের সুপারিশ করা হয়েছে। তবে প্রকৃত জেলেদের তালিকা সম্পন্নের সকল চেষ্টা চলছে।