| শিরোনাম |
❒ বাংলার মাটির শিল্পের প্রতীক এস এম সুলতান ছবি: ফাইল ফটো
আজ ১০ অক্টোবর বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের ৩১তম মৃত্যুবার্ষিকী। নড়াইলের এই কিংবদন্তি শিল্পী শুধু ক্যানভাসে রঙ নয়, এঁকেছিলেন বাংলার মানুষ ও মাটির আত্মাকে। তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে এস এম সুলতান ফাউন্ডেশন, নড়াইল জেলা প্রশাসনসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন গ্রহণ করেছে নানা কর্মসূচি।
এস এম সুলতানের রুহের মাগফেরাত কামনায় সকাল ৬টায় সুলতান কমপ্লেক্সে পবিত্র কোরআন খতমের আয়োজন করা হয়েছে। সকাল সাড়ে ৭টায় ‘শিশুস্বর্গ’-এ অনুষ্ঠিত হচ্ছে শিশুদের চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা।
সকাল সাড়ে ৯টায় শিল্পীর সমাধিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ ও পৌনে ১০টায় দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। সকাল ১০টায় শিশুদের আঁকা চিত্রকর্ম প্রদর্শনী ও সাড়ে ১০টায় পুরস্কার বিতরণ ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে।
নড়াইলের জেলা প্রশাসক ও সুলতান ফাউন্ডেশনের সভাপতি শারমিন আক্তার জাহান জানিয়েছেন, সুলতানের স্মৃতিকে সম্মান জানাতে সব আয়োজন সম্পন্ন হয়েছে। তাঁর মতো শিল্পী আমাদের জাতির অহংকার।
১৯২৪ সালের ১০ আগস্ট নড়াইল শহরের মাছিমদিয়া গ্রামে জন্ম নেন লাল মিঞা—পরবর্তীতে যিনি হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি শিল্পী এস এম সুলতান। রাজমিস্ত্রি পিতা মেছের আলীর কাজের সূক্ষ্মতা ও রঙের ছোঁয়া থেকেই তাঁর শিল্পচেতনার বীজ বপন হয়।
অষ্টম শ্রেণিতে পড়াকালীন সময়েই তৎকালীন জমিদার ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের সহায়তায় কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান তিনি। মাত্র অষ্টম শ্রেণি পাস করেও ১৯৪১ সালে বিশেষ অনুমতিতে ভর্তি হওয়া এই শিল্পী দ্রুতই নজর কাড়েন শিক্ষকদের।
১৯৪৪ সালে তৃতীয় বর্ষের পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন। তবে প্রথাগত শিক্ষায় নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখতে না পেরে তিনি পাড়ি জমান কাশ্মীরের পাহাড়ে, উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর জীবনের রঙ ও গল্প আঁকতে।
কাশ্মীর থেকে শুরু হয় সুলতানের রঙিন ভ্রমণ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, পাকিস্তানসহ নানা দেশে তাঁর চিত্র প্রদর্শিত হয় প্রখ্যাত শিল্পীদের সঙ্গে। সিমলা, লাহোর, করাচি, নিউইয়র্ক, বোস্টন, মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়, লন্ডন, ঢাকা ও জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে তাঁর কাজ প্রদর্শিত হয়েছে।
তাঁর তুলি ছুঁয়েছে বাংলার কৃষক, জেলে, তাঁতি, কামার, কুমার—এই মাটির মানুষদের। মাঠ, নদী, জঙ্গল, হাওর, বাঁওড়—সবুজ প্রান্তর তাঁর ক্যানভাসে হয়ে উঠেছে জীবন্ত।
১৯৫৫-৫৬ সালের দিকে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং নিজের জন্মভূমি নড়াইলে প্রতিষ্ঠা করেন “ফাইন আর্ট স্কুল” ও শিশুদের জন্য স্বপ্নের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘শিশুস্বর্গ’।
১৯৮০ সালে নিজ বাড়িতে শুরু করেন শিশুস্বর্গের নির্মাণকাজ। ১৯৯২ সালে ৬০ ফুট দীর্ঘ ‘ভ্রাম্যমাণ শিশুস্বর্গ’ নামে একটি নৌকা নির্মাণ করেন—যেখানে শিশুদের নিয়ে চিত্রা নদীতে ভ্রমণ করতেন, নৌকাতেই শেখাতেন আঁকার পাঠ।
চিত্রাঙ্কনের পাশাপাশি সুলতান ছিলেন বাঁশির ওস্তাদ। তাঁর হাতে প্রায়ই দেখা যেত বাঁশি। তিনি বাড়িতে পুষতেন সাপ, ভল্লুক, বানর, খরগোশ, ষাঁড়সহ নানা প্রাণী।
নিজ হাতে তৈরি করেছিলেন এক মিনি চিড়িয়াখানা—“জ্যু”—যেখানে পশু-পাখির সঙ্গে তিনি কাটাতেন সময়। হিংস্র প্রাণীকেও বশে আনতে পারতেন এই অনন্য শিল্পী।
চিত্রশিল্পী এস এম সুলতান ১৯৮২ সালে একুশে পদক, ১৯৯৩ সালে স্বাধীনতা পদক পান। ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ সরকারের রেসিডেন্ট আর্টিস্ট এবং ১৯৮৬ সালে বাংলাদেশ চারুশিল্পী সম্মাননা হিসেবেও স্বীকৃতি পান তিনি। সুলতানের স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য তাঁর নিজ বাড়িতে নির্মিত হয়েছে এস এম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা।
তাঁর নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এস এম সুলতান স্মৃতি সংগ্রহশালা, যা এখন নড়াইলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ।
দীর্ঘদিন শ্বাসকষ্টে ভুগে ১৯৯৪ সালের ১০ অক্টোবর যশোর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন এস এম সুলতান। নড়াইলের নিজ বাড়ির আঙিনায় তাঁকে সমাহিত করা হয়। চিরকুমার, অসাম্প্রদায়িক ও মানবপ্রেমী এই শিল্পী রেখে গেছেন এক অমর উত্তরাধিকার—বাংলার মানুষের মুখ ও মাটির রঙে ভরা চিত্রজগত।
এস এম সুলতান কেবল একজন চিত্রশিল্পী নন, তিনি ছিলেন এক দার্শনিক, এক স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁর ক্যানভাসে যে মানুষগুলো ফুটে উঠেছে, তারা আমাদের অস্তিত্বেরই প্রতিচ্ছবি।
আজ তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে নড়াইলের বাতাসে আবারও ভেসে বেড়াচ্ছে বাঁশির সুর—সুলতানের শিল্পের অমলিন সঙ্গীত।