Published : Saturday, 16 January, 2021 at 4:48 PM, Count : 134

পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলা রাবনাবাদ পাড়ের চারিপাড়া গ্রামটিতে তিন পুরুষের বসবাস ছিল। রাবনাবাদ নদী তিন দফা জমিজমা গিলে খাওয়ায় ৩০ বছর আগে বেড়িবাঁধের আধাকিলোমিটার ভেতওে বাড়ি করেছিলেন পঞ্চাশোর্ধ জাহানারা বেগম। বাড়িতে গাছপালা, গবাদিপশু, হাঁস-মুরগি, পুকুরে মাছ ছিল পরিপূর্ণ। চাষাবাদ করতেন জমি। রবিশস্য আবাদ করতেন। ত্রিশ বছরের সাজানো সংসার জীবনের বাড়ির উঠোনে চুলোয় রান্না করছিলেন। তিনি আরো বলেন, আজকেই এখানের শেষ রান্না। বৃদ্ধ স্বামী আনোয়ার হোসেন মালামাল মাথায় করে এক কিলোমিটার দূরে নিয়ে ভ্যানে তুলছিলেন। ছেলেবউ লামিয়া শ^শুর-শাশুড়ির ঘরের সোলার প্যানেল, ব্যাটারি, হোগলা, হাঁড়ি-পাতিলসহ গোছ করছিলেন। নয় মাসের শিশু হাবিবাকে সামলে ফাঁকে ফাঁকে লামিয়া বলছিলেন, বাড়িঘর ছেড়ে কারো যাইতে মন চায়? প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে পশুরবুনিয়ায় বাঁধের ঢালে আপাতত আবার জীবনের যুদ্ধে নামবেন এ জাহানারা। ছেলে-বউসহ ছয় জনের সংসারে আয়-রোজগার ছিল রাবনাবাদ নদীতে মাছ ধরা। কৃষিক্ষেতে কামলা দেয়া। বাড়ির পেছনের ‘নানির খালে’ মাছ ধরা। সব যেন শেষ হয়ে গেল। তিন যুগের বসতির মায়া ছাড়তে দু’চোখ ছল ছল করছিল মানুষগুলোর। সব মায়া ত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু লামিয়া-জাফর হাওলাদার পরিবার শিশুসন্তান নিয়ে কই যাবেন জানা নেই। পায়রা বন্দর নির্মাণে জমি অধিগ্রহণের আওতায় পড়া মানুষগুলো ডিসেম্বরের ৯ তারিখে বাড়িঘর ছাড়ার নোটিস পেয়েছেন। সহ¯্রাধিক বাড়িঘরের মাত্র ১৫-২০টি পরিবার এষনও যায়নি। তবে কারও ঘর নেই। ভেঙ্গে রেখেছেন। জানালেন এ পরিবারের সদস্যরা, ঘরের এবং গাছপালার ক্ষতিপূরণের টাকা তুলেছেন। তাতে এলএও অফিসসহ দালালকে শতকরা ৮-১২ টাকা দিতে হয়েছে। জাহানারার দাবি, তাদের বলা হয়েছিল আগে পুনর্বাসন পরে ঘর ছাড়তে হবে। এখন আদৌ পুনর্বাসনের ঘর পাবেন কিনা তাও জানেন না। দিশেহারা হয়ে আছেন পরিবারের লোকগুলো। জমির টাকা কবে পাবেন তা অনিশ্চিত।
আরও খারাপ দশায় শিরিনা-লতিফ প্যাদা পরিবারের। মাটির ভিটির ওপর চুলোয় হাঁড়ি বসানো। জানেন না কই যাবেন। জানালেন শিরিনা। ঘরটি ভাইঙ্গা রাখছেন। স্বামী সাগরে জাল বায়। ছয় জনের সংসার। এ পরিবারটি ঘরের টাকাও পায়নি। শুনেছেন ঘর, গাছপালা বাবদ নয় লাখ টাকা পাওয়ার কথা। একজনের ডিসপুটে (অভিযোগে) টাকা তুলতে পারছেন না। ঝুপড়িতে রাত কাটায়। দুজনেই অসুস্থ। তারপরও স্বামী মাছ ধরাসহ কামলা দেয়। এখন কই যাবেন এ পরিবারের সদস্যরা। নিজেরাও জানেন না। বড় ছেলে এইচএসসি পাস করেও ভেকু মেশিন চালায়। মেজ ছেলে ডিপ্লোমা পড়ছে। মাথায় বাঁজ পড়ার মতো অবস্থা। শিরিনার ভাষায়, ঘরের টাকা দালালের কারণে আটকে আছে। রুবেল হাওলাদার- রোকসনা দম্পতি ঘর ভেঙ্গেছেন। মালামাল গোছ করছিলেন। তিন জনের সংসার। বাব-দাদার সঙ্গে একত্রে থাকায় ক্ষতিপূরণের টাকাও জোটেনি এ তরুণ দম্পতির। দশকানি গ্রামে যাওয়ার পরিকল্পনার কথা জানালেন রুবেল। তাদেও যৌথ পরিবারের ক্ষতিপূরণ তুলতে দালাল ও এলএও অফিস মিলে ৯০ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। মাছের ব্যবসা করা এই মানুষটার জীবিকায় এখন অনিশ্চয়তা। বললেন, বাব-দাদার ১৩ জনের সংসারে যে টাকা পেয়েছেন তা দিয়ে মাথাপিছু এক কড়া জমিও কিনতে পারছেন না। দুর্ভোগ আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে মানুষগুলো হতাশা ব্যক্ত করেন। রান্না করছিলেন গৃহবধূ মাহিনুর। জানালেন, এই রান্নাই চারিপাড়া গ্রামের বাড়ির চুলোয় শেষ রান্না। চোখ দুটি ছলছল করছিল। কথাই বলতে পারলেন না। বুকে দীর্ঘশ^াস।
এভাবে মোশারফ হাওলাদার-কুলসুম বেগম দম্পতি জানালেন, ঘরের টাকা পাইছেন। কিন্তু পুনর্বাসনের ঘর পাবেন কিনা তা কেউ জানেন না।
আফজাল-মাহিনুর দম্পতি ঘরের টাকার জন্য দালাল এলএও অফিসে দুই লাখ টাকা দিয়েছেন। এরাও জানেন না পুনর্বাসনের ঘর পাবেন কিনা। ঘনবসতিপূর্ণ সহ¯্রাধিক জেলে ও কৃষক পরিবারের বসবাস চারিপাড়ার ঘরের মটি এখন খাঁ খাঁ করছে। ১০-১২টি পরিবার রয়েছে। তাও ঘর নেই। ভিটিতে পলিথিন, কাপড়ের ছাপড়া দেয়া। বহু ফলন্ত নারিকেল গাছ দাঁড়িয়ে আছে পুরনো বাড়ির সাক্ষী হয়ে। নারিকেল গাছ কেউ কেনে না। তাই কাটেনি। এসব শত শত দরিদ্র পরিবারের দাবি এবং প্রশ্ন প্রানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা নিজে বলেছেন, কাউকে পুনর্বাসনের আগে উচ্ছেদ করা যাবে না। অথচ আচমকা নোটিস দিয়ে তাঁদের কেন পুনর্বাসনের আগেই উচ্ছেদ করা হলো? এমনকি কে পুনর্বাসনের ঘর পাবে তাও তাঁরা জানেন না। এসব মানুষের মন্তব্য,পুনর্বাসনের ঘর পেলে সরাসরি সেখানে যেতে পারলে প্রত্যেক পরিবারের দুই লাখ টাকার ক্ষতি হতো না। উৎকণ্ঠিত দরিদ্র মানুষগুলো দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এরই মধ্যে এশটি মধ্যস্বত্বভোগী চক্র পটুয়াখালী এলএও অফিসের কতিপয় স্টাফের যোগসাজশে পার্সেন্টেজের নামে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।
এ ব্যাপারে লালুয়ার ইউপি চেয়ারম্যান শওকত হোসেন তপন বিশ^াস জানান, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি রক্ষা না করে পুনর্বাসনের আগে এসব দরিদ্র মানুষকে বাড়িঘর ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া ঠিক হয়নি। তিনি দ্রুত বাড়িঘরহারা মানুষকে পুনর্বাসনের আওতায় আনার দাবি জানান।