
ভারত থেকে নেমে আসা উজানের অতিরিক্ত পানিতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুরে বন্যায় তলিয়ে গেছে প্রায় তিন হাজার বিঘা জমির ধান। পুনর্ভবা নদীর পানি ঢুকে গোমস্তাপুর উপজেলার রাধানগর ইউনিয়নের বিল কুজাইনসহ কয়েকটি বিলে কৃষকদের ধান প্লাবিত হয়েছে। প্লাবিত হওয়ার আগে কেটে রাখা ধান ও পানিতে তলিয়ে থাকা ধান তুলতে বেগ পেতে হচ্ছে কৃষকদের। কারণ তীব্র আকারে দেখা দিয়েছে ধান কাটার শ্রমিকের সংকট।
সরেজমিনে গিয়ে কথা হয় কৃষক ও ধানকাটা শ্রমিকদের সাথে। তারা জানায়, স্বাভাবিক সময়ে ৩০০-৪০০ টাকা করে দিনমজুর হিসেবে ধানকাটা শ্রমিক পাওয়া গেলেও, বন্যায় ধান প্লাবিত হওয়ার পর এক হাজার টাকাতেও পাওয়া যাচ্ছে না শ্রমিক। বিশাল অংক দেখে স্থানীয় রাজমিস্ত্রী, দোকানদার, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরাও যোগ দিয়েছেন ধান কাটার শ্রমিকের কাজে।
রাধানগর ইউনিয়নের চেরাডাঙ্গা গ্রামের কৃষক আবুল আক্তার টুকু বিল কুজাইনে ১২ বিঘা জমিতে ধান চাষাবাদ করেছেন। তিনি বলেন, আমরা এখন নিঃস্ব হয়ে গেছি। বন্যার পানিতে সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। গত তিন দিন থেকে ১৬টা করে শ্রমিক আমার ধান পানি থেকে তোলার কাজ করছে। সবাইকে ১০০০ টাকা করে দিনমজুর দিতে হচ্ছে। সার-পানি-হাল চাষাবাদ সব বাদ দিয়ে ধান কাটতেই যদি এক হাজার করে টাকা লাগে, তাহলে আমরা কেমনে বাঁচব?
আক্কেলপুর গ্রামের কৃষক আবুল কালাম বলেন, আমার ধান কেটে রাখার পরই বিলে পানি চলে আসে। এখন আঁটি করা অবস্থাতেই পানির নিচে রয়েছে আমার ধান। এগুলো দ্রুত না উঠালে গেজে যাবে এবং ধান নষ্ট হয়ে যাবে। এমনকি অনেক ধানের আঁটি ভেসে বাইরে চলে যাচ্ছে। গত তিন দিন থেকে শ্রমিক খুঁজছি, কিন্তু পায়নি। বুধবার তিনজন শ্রমিককে নিয়ে ধান উঠানোর কাজ করেছি। ১০০০ টাকা করে দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।
১০ বিঘা জমি চাষাবাদ করেছেন কৃষক আব্দুল হামিদ। তিনি বলেন, আমরা জমিগুলো ইজারা নিয়ে চাষাবাদ করি। বিঘাপ্রতি জমির মালিককে দিতে হয় ১০-১২ হাজার টাকা। সার-পানি-শ্রমিক খরচ হয় আরও অন্তত ১০ হাজার। এরপর পানিতে তলিয়ে যাওয়া ধান উঠাতে শ্রমিককে দিতে হচ্ছে দৈনিক এক হাজার টাকা। একদিকে তো পানিতে ধান প্লাবিত হয়ে ফলন কমছে, অন্যদিকে খরচ বেড়েছে অনেক বেশি। সবমিলিয়ে বিঘাপ্রতি ৩-৫ হাজার টাকা লোকসান হবে।
ধানকাটা শ্রমিক তসলিম উদ্দীন জানান, অন্যান্য বছর বাইরে থেকে ধানকাটা শ্রমিক আসার কারণে এখানে শ্রমিক সংকট থাকে না। বাইরের শ্রমিক এবারও এসেছিল, কিন্তু বন্যার পানি আসার সাথে সাথে তারা চলে গেছে। এ কারণেই মূলত শ্রমিক সংকট দেখা দিয়েছে। তাই বাধ্য হয়েই এক হাজার টাকা দিয়েও শ্রমিক নিতে হচ্ছে। কারণ এখন টাকার পরিমাণের দিকে দেখে বসে থাকার সময় নাই। সব ধান পানির নিচে তলিয়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
আরেক শ্রমিক সাইফুল ইসলাম বলেন, এক মণ ধানেও একজন ধান কাটা শ্রমিক পাওয়া যায় না। কারণ এসব ধান পানির নিচে থেকে নষ্ট হয়ে গেছে। অন্যান্য ধানের মতো দাম পাওয়া যাবে না এসব ধানে। বিল কুজাইনের বন্যায় প্লাবিত ধানগুলো বিক্রি হচ্ছে ৮০০-৯০০ টাকা মণ হিসেবে। অথচ স্বাভাবিকভাবে একই জাতের ধানের দাম ১০৫০-১১০০ টাকা করে। শ্রমিক সংকট থাকায় এলাকায় বিভিন্ন পেশার যেমন রাজমিস্ত্রী, শিক্ষার্থীরাও ধানকাটা শ্রমিকের কাজ করছে।
সাবেক ইউপি সদস্য ইউসুফ আলী বলেন, সোনার ফসল ঘরে তুলতে এখন বিপাকে পড়েছেন কৃষকেরা। ধানকাটা শ্রমিকদেরকে দৈনিক ১ হাজার টাকা মজুরি দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না। এমনকি ছোট ছোট কিশোরদেরকেও কাজে নেওয়া হচ্ছে ৬০০-৭০০ টাকা করে। ইতোমধ্যে ৩ হাজার বিঘা জমির ধান প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া বিল কুজাইনসহ আশেপাশের কয়েকটি বিলে প্রায় ১২ হাজার বিঘা ফসলি জমি বন্যার হুমকিতে রয়েছে। প্রতিদিন যত পানি বাড়ছে শ্রমিক সংকট তত বাড়ছে।
গোমস্তাপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তানভীর আহমেদ সরকার জানান, বিল কুজাইনের পানি প্রবাহ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। আর পানি না কমলে ধান প্লাবিত হয়ে পানির নিচে থেকে নষ্ট হয়ে যাবে। এমনকি স্রোত ও দীর্ঘ সময় পানি থাকলে সম্পূর্ণ ধান না পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই কৃষক ভাইয়েরা এখন শ্রমিকের মজুরির দিকে না দেখে দ্রুত ঘরে তুলতে চাইছেন। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার স্রোত ও পানি বাড়ার হার বেশি। তাই প্লাবিত এলাকা থেকে পানি কম সময়ের মধ্যে কমার সম্ভাবনা খুবই কম। পলে কৃষকদের ক্ষতির সম্ভাবনাও অনেক বেশি।