
চলছে শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। বিরামহীন কর্মযজ্ঞ মুন্সীগঞ্জের মাওয়া, শরীয়তপুরের জাজিরা এবং শিবচরের কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাট প্রান্তরে। মাওয়া প্রান্তে সুধীজন সমাবেশ শুধুমাত্র আমন্ত্রিতদের জন্য হলেও কাঁঠালবাড়ির জনসভা উন্মুক্ত। পদ্মা পাড়েই তৈরি হচ্ছে জনসভার মঞ্চ। আয়েজকরা আশা করছেন স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জনসভা হবে এটি, যেখানে দশ লাখের অধিক মানুষের সমাগম ঘটবে। আর মাত্র দুই দিনের অপেক্ষা, তারপর খুলে দেয়া হবে স্বপ্নের পদ্মাসেতু। বিশ্ববাসীর সামনে বাংলাদেশের অকুতোভয় অস্তিত্ব আর আত্মমর্যাদার স্বরূপ উন্মোচিত হতে যাচ্ছে পদ্মাসেতুর সাথেই। কষ্টের সোপান পেরিয়ে সুখস্বপ্নে বিভোর দু’পাড়ের মানুষ।
পদ্মাসেতুর দুই প্রান্ত মুন্সিগঞ্জের মাওয়া এবং শরীয়তপুরের জাজিরা এখন উৎসবের নগরী। শুধু কি এই দু’প্রান্ত! ফেরিতে ঘণ্টার পর ঘন্টার অপেক্ষার বিপরীতে মাত্র তিনশ’ ৬০ সেকেন্ডের নদী পাড়ি দিতে সারাদেশের মানুষ উদগ্রীব হয়ে আছেন সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। এক লাখ সাত চল্লিশ হাজার বর্গকিলোমিটারের লাল সবুজের পুরো ভূখন্ডই এখন উৎসবের অপেক্ষায়। সেতু উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে গোটা বিশ্ব আবার দেখবে সেই বাংলাদেশকে, ‘জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার, তবু মাথা নোয়াবার নয়....’।
৮ জুন রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সেতু বিভাগ আয়োজিত পদ্মাসেতুর উদ্বোধন উপলক্ষে মতবিনিময় সভা শেষে সেতু বিভাগের সচিব মঞ্জুর হোসেন জানিয়েছিলেন, ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করার সাথে সাথেই ওই দিনই সর্বসাধারণের জন্য এটি উন্মুক্ত করা হবে না। ওই দিন প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন শেষে চলে আসার পর যেকোনো সময় প্রজ্ঞাপন দিয়ে বা গণবিজ্ঞপ্তি জারি করে জানিয়ে দেয়া হবে কখন পদ্মাসেতু সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হবে। সেটা হতে পারে পরদিন ভোর ৬টা বা ওই দিনই যে কোনো সময় থেকে।
তবে জনসাধারণের চলাচল নির্দিষ্ট করে বলা না হলেও নির্ধারিত হয়েছে ২৫ জুন প্রধানন্ত্রীর সেতু উদ্বোধনের বিষয়টি। পদ্মাসেতু উদ্বোধন উপলক্ষে দুটি অনুষ্ঠান হবে। একটি মাওয়া প্রান্তে, অন্যটি জাজিরা প্রান্তে। সকাল দশটায় মাওয়া প্রান্তের সুধী সমাবেশে নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তিন হাজার দেশি-বিদেশি বিশিষ্ট জনদের। এ তালিকায় রয়েছেন মন্ত্রিসভার সদস্য, রাজনীতিবিদ, বাংলাদেশে অবস্থানরত বিদেশি কূটনীতিক, নির্মাণ সহযোগী প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি, দেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকরা। ইতিমধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে আমন্ত্রণপত্র বিতরণের কাজ শুরু করেছে সেতু বিভাগ। এখানে শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রী বক্তব্য রাখবেন। এরপর বেলা ১১টায় তিনি মাওয়া প্রান্তে উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল উদ্বোধন করবেন। নামফলক উন্মোচন করে টোলপ্লাজায় টোল দিয়ে পদ্মাসেতু পার হবেন তিনি। এরপর জাজিরা প্রান্তেও উদ্বোধনী ফলক ও ম্যুরাল থাকবে, সেটিও উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী।
ওইদিন বিকেলে মাদারীপুরের শিবচরে কাঁঠালবাড়ি ফেরিঘাটে পদ্মাসেতুর উদ্বোধন উপলক্ষ্যে আয়োজিত জনসভায় বক্তৃতা করবেন তিনি। আয়োজকরা আশা করছেন স্মরণকালের সর্ববৃহৎ জনসভা হবে এটি, যেখানে দশ লাখের অধিক মানুষের সমাগম ঘটবে। ইতিমধ্যে এখানে চলছে বিরামহীন প্রস্তুতি। পদ্মা নদীর পাড়েই তৈরি হচ্ছে মঞ্চ।
পদ্মাসেতু উদ্বোধন উপলক্ষ্যে আগামী ২৫ জুন বুড়িগঙ্গা সেতু, ধলেশ্বরী সেতু এবং আড়িয়াল খাঁ সেতুর টোল বাতিল করেছে সেতু বিভাগ। ২০ জুন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ফাহমিদা হক খান স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে এ নির্দেশনা জারি করা হয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, পদ্মাসেতু উদ্বোধনের দিন কেবল ২৫ জুন অভ্যাগত অতিথিদের যানবাহনসহ সাধারণ যানবাহনের যানজটবিহীন নির্বিঘ্ন চলাচল নিশ্চিত করার স্বার্থে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মহাসড়কের একই করিডোরে অবস্থিত বুড়িগঙ্গা সেতু, ধলেশ্বরী সেতু ও আড়িয়াল খাঁ সেতুর টোল মওকুফ করা হলো।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সমীক্ষায় পদ্মাসেতু হবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমের ২১ জেলার যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। প্রতিদিন এই সেতু দিয়ে চলবে ২৪ হাজার যানবাহন। পদ্মা সেতুতে মাসিক টোল আদায় হবে ১৩৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। টোল নিতে সেতুর দুই প্রান্তে থাকছে সাতটি করে ১৪টি লেন। টোল আদায় ও সেতুর রক্ষণাবেক্ষণে কোরিয়া এক্সপ্রেস করপোরেশন ও চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানির সঙ্গে এরই মধ্যে চুক্তি করেছে সেতু বিভাগ। টোল দিয়ে পদ্মা সেতু পার হতে সব মিলিয়ে সময় লাগবে ৩৬০ সেকেন্ড। অথচ এ দূরত্ব ফেরিতে পারাপারে সময় লাগত অন্তত দেড় ঘণ্টা।
এদিকে, পদ্মাসেতুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে ঘিরে সেতু এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেতুর আশপাশের সড়কগুলোতে বসানো হয়েছে ক্লোজসার্কিট ক্যামেরা। বাড়ানো হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা। যেকোনো ধরনের নাশকতা এড়াতে গোয়েন্দা নজরদারি, সাইবার মনিটরিং এবং পেট্রোলিং বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া, জনসভা ও সমাবেশস্থল ঘিরে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের কঠোর নজরদারি চলছে। তবু থেমে নেই উৎসবের প্রস্তুতি।
শরীয়তপুর জেলা প্রশাসক পারভেজ হাসান জানান, স্বপ্নের পদ্মাসেতু উদ্বোধন উপলক্ষে আয়োজন করা হয়েছে ‘সমৃদ্ধির উৎসব’ শিরোনামে তিনদিনের অনুষ্ঠানমালা। ২৫ জুন থেকে ২৭ জুন চলবে উৎসব। শহীদ বীরশ্রেষ্ঠ ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রউফ স্টেডিয়ামে হবে আনন্দ সমাবেশ এবং মনোমুগ্ধকর সাংস্কৃতিক পরিবেশনা।