শিরোনাম |
অপসংস্কৃতি থেকে জাতিকে বের হয়ে আসতে হবে জানিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, আফসোস, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আমি শহীদের পরিবারের একজন হতে পারলাম না।
তিনি বলেন, এই যুদ্ধে স্বজন হারানোর শোকগুলো একত্র করে আমরা শক্তিতে রূপান্তর করব এবং অঙ্গীকার নেব যে আমরা শহীদদের মর্যাদা রাখব। তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করব না। জামায়াত ইসলামী একটি ইসলামী রাজনৈতিক দল। আমরা চাই সৎ নেতৃত্ব বসুক। দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব বসুক। যারা গদিকে নিজেদের বাপ-দাদার সম্পদ মনে করবে না। আর জনগণকে নিজেদের দাস বানানোর চিন্তা করবে না। বরং জনগণের চৌকিদার হিসেবে নিজেদের মনে করবে। জনগণ শান্তিতে ঘুমাবে আর উনারা রাত জেগে জনগণকে পাহারা দেবে।
আজ বৃহস্পতিবার (২৯ আগস্ট) নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, আসলে আমাদের ইতিহাস বড়ই বিচিত্র। ইতিহাসের পালা বদলে আমরা বন্ধুকে শত্রু বানাই, শত্রুকে বন্ধু বানাই। এরকম যে জাতি করে সেই জাতি কোনোদিন বিশ্বের দরবারে ও নিজের বিবেকের কাছে সম্মানিত হতে পারে না। অপসংস্কৃতির এই যন্ত্রণা থেকে এই জাতিকে বের হয়ে আসতে হবে। জাতির জন্য যার যেখানে যে অবদান এটা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করতে হবে।
জামায়াতে ইসলামীর আমির বলেন, আমরা আজকে শহীদ পরিবারের কাছে এসেছি সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য নয় বরং আমরা এসেছি অনুপ্রেরণা নেওয়ার জন্য। তারা বড়ই সৌভাগ্যবান। শুধু শহীদদের হাশরের দিন আল্লাহ জিজ্ঞেস করবেন, তুমি তোমার জীবনের সর্বোচ্চ সম্পদ আমার জন্য দান করেছো। আজকে আমি আমার জান্নাতের সব দুয়ার তোমার জন্য খুলে দিলাম। আমার আফসোস এবারের এই যুদ্ধে আমি শহীদের পরিবারের একজন হতে পারলাম না। এ সৌভাগ্য যাদেরকে আল্লাহ দান করেছেন তাদেরকে আমার ঈর্ষা হয়। আমি যদি তাদের একজন হতাম। আমরা আজকে ঘোষণা করতে এসেছি আমরা আপনার পরিবারের সদস্য হতে চাই।
তিনি আরও বলেন, এই আন্দোলন-সংগ্রামে জাতি, ধর্ম ও দলের মধ্যে কোনো ব্যবধান ছিল না। এখানে অন্য ধর্মের অনেক লোকও নির্মমভাবে মারা গেছেন। আমরা এদের সকলকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবো। জাতি হিসেবে আমরা ঋণী। আজীবন যেন এ জাতি এই ঋণের অনুমতি নিয়ে চলে এবং ঋণ আদায়ের চেষ্টা করে আল্লাহর কাছে। আমি এই সরকার (শেখ হাসিনার সরকার) সম্পর্কে কিছুই বলব না। তাদের বিষয়টা আল্লাহর হাতে সোপর্দ করে দিলাম। রক্তের একেকটা ফোয়ারা মিলিত হয়ে রক্তের প্লাবন সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের এমন কোনো জনপদ নেই যা রক্তাক্ত হয়নি।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, শহীদরা তো মহা সৌভাগ্যবান। তারা চলে গেল। মায়েরা তাদের ফিরিয়ে আনার কথা বলবেন না। তারা জান্নাতের পথের অগ্রসৈনিক। বিভিন্ন হাসপাতালে বাড়িতে আহত ভাই-বোনদেরকে দেখতে গিয়েছি। কলিজা ফেটে গেছে। যখন দেখেছি যুবক ছেলে দুই চোখে গুলি লেগে অন্ধ হয়ে গেছে। আহ! সে তো আর জীবনে আলো দেখবে না। আলো নিভে গেছে তার। যতদিন বেঁচে আছে কারও সাহায্য ছাড়া একটি কদমও ফেলতে পারবে না। এদের বাবা-মাকে আমরা কী সান্ত্বনা দেব। এদের আপনজনকে আমরা কী সান্ত্বনা দেব। সেদিন এই নারায়ণগঞ্জে এসেছিলাম। আমাদের শহীদ বোন সুমাইয়া। তার আড়াই মাসের নিষ্পাপ শিশুর দিকে তাকাইয়ে আমরা নিজেদের ধরে রাখতে পারিনি। ও কাকে মা বলে ডাকবে। একটা বাচ্চার সবচেয়ে বেশি সম্পর্ক তার মায়ের সঙ্গে। ওই মায়ের রক্ত খেয়ে সে বড় হয়েছে। সে তার মায়ের নাড়িছেঁড়া ধন। যখন সে দেখবে অন্য বাচ্চারা মা মা বলে ডাকছে তখন সে মা বলার জন্য কাউকে খুঁজে পাবে না। ওদেরকে আমরা কী সান্ত্বনা দেব! যারা ক্ষমতার জন্য এত বেপরোয়া হয়ে গেল তারা কি একটি বারও চিন্তা করলো না যে এরাও মানুষ। এরা এই দেশের নাগরিক। কত বাচ্চাকে এতিম করে দিয়েছে। কত যুবতী মেয়েকে বিধবা বানিয়ে ফেলেছে। কত বাবাদের বুক ভেঙে দিয়েছে। একটাবারও কি তারা চিন্তা করল না!
তিনি আরও বলেন, রাজশাহীতে গিয়েছিলাম। এক ভাই রিকশা চালিয়ে কোনোরকমে জীবন চালাতেন। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের সময় সেই যুবক নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি। রিকশা গ্যারেজে ফেলে এক কলসি পানি নিয়ে, একটি গ্লাস হাতে দৌড়ে গেছে। যারা এই কঠিন রোদের মধ্যে কষ্ট করছে তাদের হাতে একটু পানি তুলে দেবে। পানি খাওয়া শেষ। কলসি একদিকে রেখে সেও নেমে গেছে ওদেরকে সাহায্য করতে। জালিমের তিনটা বুলেট এপার ওপার করে তাকে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিয়েছে। তার বিয়ে হয়েছে এক বছর হলো, তার স্ত্রী পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমি চিন্তা করলাম এই মেয়েটা যদি আমার ঔরসজাত মেয়ে হত তাহলে আমার অনুভূতি কি হত।
আমি মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলাম মারে তোমার অনুভূতি কি, তুমি কেমন আছো? আমাকে বলল বাবা আমি যেমনই থাকি, আমি আমার গর্ভের সন্তান নিয়ে চিন্তিত। ওর কী হবে? ও তো একজন গরিব রিকশাওয়ালার সন্তান, আমার পেটে রেখে দিয়েছি। আমি কী পারব তাকে মানুষ করতে? এই মেয়েকে বললাম আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে, তোমার যাবতীয় দায়িত্ব জামায়াতে ইসলামী কবুল করলো। তোমাদের বেঁচে থাকা, বেড়ে ওঠা আল্লাহ রহমত দিবেন। মানুষ হিসেবে আমরা তোমার পাশে থাকব। এখন থেকে প্রতিমাসে তোমাদের চলার মতো একটি অংশ তোমাদের কাছে পৌঁছে যাবে ইনশাআল্লাহ। দোয়া করি তোমার গর্ভের সন্তান দুনিয়ায় আসুক। মেয়ে হোক ছেলে হোক আল্লাহ যা পছন্দ করেছেন তোমার জন্য যেন চক্ষু শীতলকারী হয়। ও বড় হওয়া পর্যন্ত লেখাপড়াসহ যা কিছু প্রয়োজন ইনশাআল্লাহ আমরা দায়িত্ব নিলাম।
জামায়াতের আমির বলেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বসেছিলাম। আমরা বলেছি যে পরিবারগুলোর আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন তাদের জন্য অর্থ সহায়তা দেওয়ার। পদক্ষেপ আপনারা করবেন। রাষ্ট্রের সকল খাতের সঙ্গে এটাকে আপনারা সর্বাধিক অগ্রাধিকার দেবেন। আহতদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা দেওয়ার চেষ্টা করুন। আমরা আপনার পাশে আছি। তারা কথা দিয়েছেন এটা করবেন।
তিনি আরও বলেন, সকলে বলছে এটা আমাদের দ্বিতীয় স্বাধীনতা, কিন্তু আমার দৃষ্টিতে এটা আমাদের তৃতীয় স্বাধীনতা। ১৯৪৭, ১৯৭১ আর ২০২৪। এই তৃতীয় স্বাধীনতার বীরদের বীরত্বগাথা আমাদের পাঠ্যপুস্তকসহ সকল জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় স্থান করে দিতে হবে। এটা তাদের পরিবারের চাহিদা নয় এটা আগামী প্রজন্মের চাহিদা। আগামী প্রজন্ম জানবে যে আমাদের আগের তরুণরা, যুবকরা এই দেশের মানুষরা হকের পক্ষে বুক টান করে দাঁড়িয়ে ছিল। তারা বলেছিল ‘বুকের ভেতর তুমুল ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’। আমরা আমাদের জাতির জন্য বুক পেতে লড়াই করব যদি একটি জাতি সেরকম দাঁড়াইয়া যায় কোনো স্বৈরাচার সেখানে মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।
ডা. শফিকুর রহমান বলেন, শহীদের রক্ত শুকিয়ে গেছে। সেটা যেন আমাদের অন্তর থেকে চলে না যায়। এখনো অনেক লোক নিখোঁজ আছে। কোথায় তাদের মরদেহ তাদের আপনজন কেউ জানে না। আসলেই কি তারা জীবিত নাকি দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে কেউ জানে না। সেই রাতগুলোতে অনেক অপকর্ম হয়েছে। যেমনটি হয়েছিল ২০১৩ সালের শাপলা চত্বরে। সারা দেশ থেকে আসা ওলামায়ে কেরামদের সঙ্গে যে নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়েছে। সেই রাতের মরদেহগুলো কোথায় গিয়েছে কেউ জানে না।