শিরোনাম |
২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শপথ নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে এবং দলটির সভানেত্রী শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। এরপর থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে তুলতে সর্বোচ্চ আন্তরিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিটি সেক্টরেই লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া ও খুলে গেছে সম্ভাবনার নতুন নতুন দ্বার। সমুদ্র বিজয় এবং মহাকাশ বিজয়, পদ্মা সেতু, মেট্রো রেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ তো পুরো জাতির সামনে দৃশ্যমান। কিন্তু এমন অনেক কাজ আছে, যা মানুষের চোখের আড়ালে রয়ে গেছে; যার সুযোগ-সুবিধা মানুষ পাচ্ছে। তেমনই একটা ক্ষেত্র হলো স্বাস্থ্য খাত।
১৭ কোটি মানুষের দেশ এই বাংলাদেশ যা পৃথিবীর অষ্টম জনবহুল দেশ। বিশাল এই জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণ মোটেও সহজ কথা নয়। বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে সরকারিভাবে প্রায় বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়ে থাকে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তুলনায় অপেক্ষাকৃত কম খরচে মৌলিক চিকিৎসা সেবা পূরণ, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল, অসংক্রামক রোগসমূহের ব্যবস্থাপনা ও প্রতিরোধে ব্যাপক উদ্যোগ, পুষ্টি উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সূচকসমূহের ব্যাপক অগ্রগতিতে স্বাস্থ্য অবকাঠামো খাতে অভূতপূর্ব অর্জন বর্তমানে দেশকে এগিয়ে নিয়েছে অনেক দূর। কেবল শহরে নয়, বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামেও এখন রয়েছে কমিউনিটি ক্লিনিক, যাতে গ্রামের মানুষ সহজেই স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারে।
বর্তমান সরকারের জনস্বাস্থ্য খাতে গৃহীত অন্যতম পদক্ষেপ সমূহ হলো:
কমিউনিটি ক্লিনিক ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা: গ্রামীণ দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বর্তমান সরকার সারাদেশে ১৪ হাজার ২৮৪টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন করেছে যার মাধ্যমে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ ঘরের দোরগোড়ায় বসে প্রাথমিক বিভিন্ন স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন। এসব ক্লিনিকে বিনা মূল্যে ৩২ রকমের ওষুধ দেওয়া হয় এবং প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩০ জন রোগী এসব ক্লিনিক থেকে সেবা গ্রহণ করে থাকে।
উল্লেখ্য যে, গ্রামীণ দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রাথমিক চিকিৎসাসেবার লক্ষ্যে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এসে প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন শুরু করেন। ২০০১ সালে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এসে কমিউনিটি ক্লিনিকের মতো জনবান্ধব মানবিক উদ্যোগকে শুধু রাজনৈতিক রোষে বন্ধ করে দিয়েছিল।
শক্তিশালী স্বাস্থ্য অবকাঠামো নির্মাণ: বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে সাম্প্রতিক সময়ে দেশের হাসপাতালের শয্যাসংখ্যা আগের চেয়ে প্রায় সাত হাজার বৃদ্ধি পেয়েছে। রাজধানীসহ সারা দেশের বিভিন্ন জেলায় নতুন নতুন বিশেষায়িত ও জেনারেল হাসপাতাল নির্মাণ করা হয়েছে।
দেশের প্রায় ৫০০টি উপজেলায় ২৫ বেড থেকে বর্তমানে ৫০ বেডের আধুনিক হাসপাতাল করা হয়েছে। প্রতিটি জেলা হাসপাতালকে ২৫০ বেডে উন্নীত করা হয়েছে। ২২টি ৫০০ বেডের আধুনিক মানের চিকিৎসা ইনস্টিটিউট, ১০০০ বেডের ৩৭টি মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল এবং পাঁচটি মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় করা হয়েছে।
সম্প্রতি ঢাকা শিশু হাসপাতালকে পূর্ণাঙ্গ জাতীয় শিশু ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, বিশ্বের বৃহৎতম শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট, জাতীয় ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স, জাতীয় ক্যান্সার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় হূদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় কিডনি ডিজিসেস ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, জাতীয় ইনস্টিটিউট অব ইএনটি, শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালসহ মোট ১৩টি বিশেষায়িত হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে।
ওষুধ শিল্পে সফলতা: স্বাধীনতার পর দেশে জরুরি ওষুধের মারাত্মক সংকট দেখা গিয়েছিল, যা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে বাংলাদেশ আজ ওষুধ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ। দেশের প্রায় ৯৮ ভাগ চাহিদা মিটিয়ে ১২৭টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করা হচ্ছে।
বিনামূল্যে টিকাদান কার্যক্রম: দেশে যক্ষা, ডিপথেরিয়া, হুপিং কাশি, মা ও নবজাতকের ধনুষ্টঙ্কার, হেপাটাইটিস-বি, হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা-বি, নিউমোকক্কাল নিউমোনিয়া, পোলিও মাইলাইটিস, হাম ও রুবেলা-এই ১০ রোগের বিরুদ্ধে নিয়মিত টিকাদান কর্মসূচি পরিচালিত হচ্ছে।
সম্প্রতি এই কার্যক্রমে জরায়ু মুখ কান্সার প্রতিরোধ টিকা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ইপিআই কর্মসূচির মাধ্যমে সারাদেশে বিনামূল্যে এ টিকাগুলো দেয়া হয়। ১৯৮৫ সালে টিকাদানের হার মাত্র দুই শতাংশ হলেও বর্তমানে তা ৯৮ শতাংশেরও বেশি।এ কর্মসূচির ফলেই দেশে মা ও শিশু মৃত্যুর হার কমানোর পাশাপাশি পঙ্গুত্ব রোধ করা সম্ভব হচ্ছে।
স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়নে তথ্য প্রযুক্তি: বর্তমান সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রতিজ্ঞার বাস্তবায়ন হিসেবে স্বাস্থ্যখাতেও ডিজিটালাইজেশন শুরু হয়েছে। দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেলিমেডিসিন সেবার মাধ্যমে রোগীদের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা পাওয়ার সুবিধা প্রদান করা হয়েছে।
এছাড়া ‘স্বাস্থ্য বাতায়ন’ ১৬২৬৩ সার্বক্ষণিক কল সেন্টারের মাধ্যমে সারা দেশ থেকে যেকোনো মানুষ যেকোনো সময় স্বাস্থ্যসেবা-সংক্রান্ত যেকোনো তথ্য জানতে পারছে। ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলে স্বাস্থ্যসেবা নিতে পারছে। আবার জাতীয় তথ্য বাতায়ন ৩৩৩, সুখী পরিবার ১৬৭৬৭ এবং আইইডিসিআরের ১০৬৫৫ নাম্বারে ফোন করে টেলিমেডিসিন সেবা গ্রহণ করতে পারছে।
করোনা মোকাবেলায় গৃহীত পদক্ষেপ: করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিশ্বে পঞ্চম স্থান ও দক্ষিণ এশিয়ায় চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। করোনায় এত বড় সাফল্যের মূলে রয়েছে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সময়োপযোগী ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ।
স্বল্প সময়ে অধিক জনবল কাজে লাগিয়ে দেশের লক্ষ্যমাত্রার ৯০ শতাংশ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে। এই টিকার প্রায় ৩৭ কোটি ডোজ মানুষকে বিনা মূল্যে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ করোনায় কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছে।করোনায় দেশের হাসপাতালগুলোতে থাকা মাত্র ৫৭৮টি আইসিইউ বেড থেকে বর্তমানে ২০০০টি আইসিইউ বেডে উন্নীত করা হয়েছে। মাত্র একটি সেন্ট্রাল লাইন অক্সিজেন প্লান্ট থেকে দেশে এখন ১২০টি সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন করা হয়েছে।
চিকিৎসা শিক্ষার প্রসার: বর্তমানে আমাদের যতগুলো পাবলিক ও প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ আছে অনেক দেশে তার ধারে কাছেও নাই। বর্তমানে দেশে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ১০৯টি এবং আর্মি পরিচালিত ছয়টি মেডিকেল কলেজ রয়েছে।
এছাড়া মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে পাঁচটি। দেশে সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজ ও বিশেষায়িত শিক্ষা ও মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিপুল সংখ্যক চিকিৎসক, শিক্ষকসহ প্রয়োজনীয় জনবল তৈরি হয়েছে; যারা স্বাস্থ্যক্ষেত্রে অসামান্য অবদান রাখছেন।
নার্সিং অ্যান্ড মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর গঠন: বাংলাদেশের নার্সিং ব্যবস্থাপনা ও সার্বিক উন্নয়নের লক্ষ্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধিনস্থ ১৯৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত পরিদপ্তরকে ২০১৬ সালের ১৬ নভেম্বর নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর হিসেবে উন্নীত করেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এখান থেকে বাংলাদেশের সরকারি খাতের নার্সিং ও ধাত্রীবিদ্যা সম্পর্কিত সমস্ত কার্যক্রম পরিচালিত হয়। প্রায় ৩০০০ টি ধাত্রী পোস্ট চালু করা হয়েছে যার ফলে মাতৃ মৃত্যু ও শিশু মৃত্যুহার কমেছে।
তাছাড়াও জনসাস্থ্য খাতে বর্তমান সরকারের গৃহীত উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ সমহু হলো:
দেশে প্রায় ৫ লাখ অটিজম আক্রান্ত শিশুদের বিনামূল্যে সেবা প্রদানের জন্য ১০৩ টি সেবাকেন্দ্র নির্মাণ।
ব্যস্ত মহাসড়ক এলাকায় ট্রমা কেন্দ্র স্থাপন।
দেশের প্রতিটি জেলায় শিশু হাসপাতাল নির্মাণ।
মা ও শিশুদের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য ৩০০০০ এর অধিক স্যাটেলাইট ক্লিনিক স্থাপন।
বেসরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবায় বিনিয়োগে উৎসাহ প্রদান।
মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জন্য বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা প্রদান।
জনস্বাস্থ্যে উল্লেখযোগ্য অগ্রিগতি অর্জন করায় বর্তমান সরকার ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক পুরুস্কার অর্জন করেছেন। তবে এই চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আরও আধুনিক ও যুগোপযোগী করতে হবে। সেই কারনে বর্তমান সরকারের বিকল্প নেই, তাই আমাদের আবারও আস্থা রাখতে হবে শেখ হাসিনার প্রতি।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, পাবলিক হেল্থ অ্যান্ড ইনফরমেট্রিক্স বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।