gramerkagoj
বৃহস্পতিবার ● ৯ মে ২০২৪ ২৫ বৈশাখ ১৪৩১
gramerkagoj
মতামত
শেখ হাসিনায় আস্থা ও নতুন মন্ত্রিসভায় প্রত্যাশা
প্রকাশ : বুধবার, ১৭ জানুয়ারি , ২০২৪, ০৯:১১:০০ পিএম , আপডেট : বুধবার, ৮ মে , ২০২৪, ০১:২৬:৪৫ পিএম
প্রফেসর ড. মো. রাশেদুল ইসলাম:
GK_2024-01-17_65a7ee5e0846f.jpg

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ টানা চারবার সরকার গঠন করল। পাঁচবার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। ৭ জানুয়ারি ২০২৪ হয়ে যাওয়া দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং নতুন সরকার নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই। এখন পর্যন্ত মন্ত্রিসভার কলেবর ৩৬ জনের। ২৫ জন পূর্ণমন্ত্রী এবং ১১ জন প্রতিমন্ত্রী। এর বাইরে মন্ত্রীর মর্যাদায় ৬ জন উপদেষ্টা, প্রধানমন্ত্রীর। এই যে আওয়ামী লীগের ওপর জনগণের আস্থা তা কি একদিনে হয়েছে?

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের একটি ঐতিহ্যবাহী ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল। দলটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দানকারী প্রধানতম দল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন তৎকালীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের একাংশের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার টিকাটুলির কেএম দাশ লেন রোডের রোজ গার্ডেন প্যালেসে 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ' প্রতিষ্ঠিত হয়। যার সভাপতি ছিলেন টাঙ্গাইলের মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং সাধারণ সম্পাদক টাঙ্গাইলের শামসুল হক।

১৯৫২ সালে শেখ মুজিবুর রহমান সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। পরের বছর ঢাকার 'মুকুল' প্রেক্ষাগৃহে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সম্মেলনে তাকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত ১৩ বছর সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তাঁর আগে ১৯৫৫ সালে মওলানা ভাসানীর উদ্যোগে ধর্ম নিরপেক্ষতার চর্চা এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগঠনটির নাম থেকে 'মুসলিম' শব্দটি বাদ দিয়ে নাম রাখা হয়: 'পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ' এবং সে বছরেই অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক আদর্শের অধিকতর প্রতিফলন ঘটানোর জন্য নাম করা হয় "আওয়ামী লীগ"।

প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আওয়ামী লীগ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের ওপর বিশেষ গুরুত্বসহ ৪২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করে। শুরুর দিকে দলটির প্রধান দাবিগুলোর মধ্যে ছিল রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি, এক ব্যক্তির এক ভোট, গণতন্ত্র, সংবিধান প্রণয়ন, সংসদীয় পদ্ধতির সরকার, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং তৎকালীন পাকিস্তানের দু'অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য দূরীকরণ।

পাকিস্তানের ২৪ বছরের শোষণ এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পোড়ামাটি নীতির ফলে পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হলে দলটির নাম হয় “বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ”। ১৯৭০ সাল থেকে এর নির্বাচনী প্রতীক নৌকা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয়লাভ করে। পাকিস্তানি শাসকদের স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব ও শোষণের ফলস্বরূপ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর আওয়ামী লীগ প্রথম সরকার গঠন করে।

স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন তখন দেশ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত, পোড়ামাটির ভূখণ্ড। সেখান থেকে মাত্র সাড়ে তিন বছর তিনি দেশ পুনর্গঠনে কাজ করেছেন। ওই সময়ের মধ্যে তিনি সংবিধান প্রণয়ন করেন। প্রশাসন পুনর্বিন্যাস এবং সব বাহিনী গঠন করেন। একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় যতগুলো অঙ্গ থাকা দরকার সবই তিনি করে দিয়েছিলেন।
সদ্য স্বাধীন দেশকে প্রায় ৭০টির মতো দেশ স্বীকৃতি দিয়েছিল। তাঁর পরিকল্পিত ও সুদক্ষ নেতৃত্বে স্বল্প সময়েই বাংলাদেশ বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হয়। স্বল্পোন্নত দেশের কাতারে উঠে বাংলাদেশ। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশের অগ্রগতি থেমে যায়।

পঁচাত্তর-পরবর্তী সরকারগুলো জনবিচ্ছিন্নতা, লুটপাট ও দর্শনবিহীন রাষ্ট্র পরিচালনা বাংলাদেশকে একটি মর্যাদাহীন রাষ্ট্রে পরিণত করে। ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ ঝড়, জলোচ্ছ্বাস এবং ভিক্ষুক-দরিদ্র-হাড্ডিসার তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ হিসেবে পরিচিতি পায়। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্র পরিচালনার সাড়ে তিন বছরের মাথায় তাঁকে ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী সরকার প্রতিষ্ঠা, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন মুছে দেওয়া, স্বাধীনতার মূল্যবোধকে ধ্বংস করে পাকিস্তানি ভাবধারায় রাষ্ট্র পরিচালনার চেষ্টা করা হয়। ফলে এই সময়ে বাংলাদেশ খুব বেশি এগোতে পারেনি। এরপর সব মিলিয়ে ৫২ বছরের মধ্যে ২৯ বছর বিএনপি-জামায়াতসহ অন্যরা ক্ষমতায় ছিল। যাদের পথচলা ছিল স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। বঙ্গবন্ধু যেখানে দেশকে নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখান থেকে এই ২৯ বছর রাষ্ট্র উলটো ধারায় চলেছে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ পুনরায় সরকার গঠন করে। তখন দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল প্রায় ৫৫ শতাংশ। সরকার গঠনের পর দারিদ্রতা বিমোচনে বেশকিছু যুগান্তকারী উদ্যোগ গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন শেখ হাসিনার সরকার । দরিদ্র ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন ভাতা চালু, তাদের জন্য বিশেষ কর্মসূচি—যেমন আশ্রয়ণ প্রকল্প, ঘরে ফেরা, কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের মতো কর্মসূচি দারিদ্র্য বিমোচন এবং প্রান্তিক মানুষের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখে।

কৃষক ও কৃষিবান্ধব নীতি গ্রহণের ফলে দেশ দ্রুত খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে। পাশাপাশি বিভিন্ন খাতে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি নীতিমালা গ্রহণের ফলে সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়তে শুরু করে অর্থনীতিতে। এরপর দেশীয় ও বিদেশি নানামুখী ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ২০০১ সালে স্বাধীনতার চেতনাবিরোধী জামায়াতের দোসর বিএনপি আবার ক্ষমতায় এসে ‘হাওয়া ভবন’ খুলে অবাধে রাষ্ট্রীয় সম্পদের লুটপাট চালাতে থাকে। তারই পরিণতিতে ২০০৭ সালের সামরিক বাহিনী নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়।

যে সরকার ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে বিনা কারণে শেখ হাসিনাসহ দলের অন্যান্য নেতৃস্থানীয়দের কারাবন্দীর মাধ্যমে স্বাধীন দেশের ভিতর পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখতে অপচেষ্টা চালায়। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি সরকার গঠনের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। মূলত এরপর থেকেই জনগণের আস্থা ও ভালোবাসায় একটানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকার সুযোগ পায় আওয়ামী লীগ। এই সময়ে দেশের উন্নয়ন-অগ্রগতির পাশাপাশি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের মধ্য দিয়ে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হয়।

বিচারহীনতার সংস্কৃতি দূর ও একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের মাধ্যমে অনেকের রায়ও কার্যকর হয়। এই সময়ে যে বাংলাদেশ ছিল তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ, সেই বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পায়। অথচ ২০০৭-২০০৮ সালে মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ৭০০ ডলারের নিচে। ১৪ বছরে সেটা ২৭৬৫ ডলার ছাড়িয়ে গেছে।

১৪ বছরে মাথাপিছু আয় বেড়েছে চারগুণ। এর সঙ্গে রিজার্ভ, রপ্তানি আয়, রেমিট্যান্স বেড়েছে উল্লেখ করার মতো। বাংলাদেশ এখন নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু করতে পারছে। এ ছাড়া কর্ণফুলী টানেল, পায়রা বন্দর, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ রাস্তাঘাটের উন্নয়ন হয়েছে ব্যাপকভাবে। শিক্ষা ও বিদ্যুৎ ক্ষেত্রে উন্নয়ন হয়েছে। সমুদ্র বিজয় হয়েছে যা দেশের ভূখণ্ডে যোগ করে নতুন একটি মাত্রা। এছাড়া ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল হয়েছে যাতে প্রায় এক কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে।

কিন্তু ২০২০ সালে করোনা শুরু হওয়ার পরে সারাবিশ্বে মানবসভ্যতা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বলা যায় পৃথিবী অচল হয়ে গিয়েছিল। এর পর থেকে এখনো অবস্থা পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। এর মাঝেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। ডলারে মান বেড়েছে টাকার মান কমেছে, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে তথাপি জ্বালানি সংকটসহ নানামুখী সংকট মোকাবিলার পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখার ক্ষেত্রে সরকার যথেষ্ট সফলতার পরিচয় দিয়েছে।

১৪ বছর আগের আর আজকের বাংলাদেশের মধ্যে বিরাট ব্যবধান এখন লক্ষণীয়। মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেছে, ক্রয়ক্ষমতা বেড়েছে। এদেশের মানুষ ভালো কিছুর স্বপ্ন দেখা ভুলেই গিয়েছিল। মানুষ আজ স্বপ্ন দেখে। স্বপ্ন দেখে উন্নত জীবনের। স্বপ্ন দেখে সুন্দরভাবে বাঁচার। সেই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের বিকল্প নাই।

এক সময় যেখানে প্রমত্তা পদ্মা নদীর ওপর সেতু নির্মাণ ছিল মানুষের স্বপ্নেরও অতীত। এখন সেটি সত্যি। আওয়ামী লীগ তাঁর নির্বাচনী ইশতেহার যে বিষয়গুলো দিয়েছিল, তাঁর সবই পূরণ করা হয়েছে বলে মনে করি। দারিদ্র্য বিমোচনে সরকার কাজ করছে এবং যথেষ্ট সফলতা রয়েছে। বেকার সমস্যা সমাধানে সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। নতুন নতুন নানা ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। সারা দেশের জেলায় জেলায় হাইটেক পার্ক স্থাপন করা হয়েছে। সরকারের লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং কর্মসূচির মধ্য দিয়ে অনেকে ঘরে বসেও আয় করার সুযোগ পাচ্ছে।

বর্তমানে শিক্ষার হার ৭৪ শতাংশ অতিক্রম করেছে। কেউ যাতে গৃহহীন না থাকে, সেজন্য একাধিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। জমি আছে ঘর নেই-এমন পরিবারের জন্য ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হচ্ছে। সরকার ফোর-জির পর ফাইভ-জি প্রযুক্তি চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। আর্মড ফোর্সেস গোল-২০৩০-এর আলোকে প্রতিটি বাহিনীকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে।

বহিঃশত্রুর যেকোনো আক্রমণ বা আগ্রাসন মোকাবিলায় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে সক্ষম করে গড়ে তুলতে যা যা করণীয় তা করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ সরকার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সক্ষমতা যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছে। সর্বোপরি আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যত উন্নয়ন ও অগ্রগতি হয়েছে, তা অন্য কোন সরকারের আমলে হয়নি। তাই এদেশের মানুষ উন্নয়নের অগ্রপথিক শেখ হাসিনাতেই আস্থা ও বিশ্বাস রাখতে চায়। তারা মনে করে, নৌকা মানে উন্নয়ন, আর উন্নয়ন মানেই নৌকা।

লেখক: চেয়ারম্যান, জেনেটিক্স এন্ড এনিম্যাল ব্রিডিং বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (হাবিপ্রবি), দিনাজপুর-৫২০০।

আরও খবর

🔝