
বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিচিতি নম্বর-০১৬৫০০০৩৮৫৬
লাল মুক্তিবার্তা নম্বর-০৪০৭০১০১৮৫
গেজেট নং-২৫২
পিতা- পুলিন বিহারী বিশ^াস
মাতা- আমদিনি বিশ^াস
১৯৫৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি যশোর জেলার মণিরামপুর উপজেলার সুজাতপুর মশিয়াহাটিতে জন্মগ্রহণ করেন।
পেশা-অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক
১৯৭১ সালে মার্চের ভয়াল কালরাত্রের পর সারাদেশের মত পাকিস্তানি সেনারা তাদের এ দেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় খুন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগের মত ভয়াল কর্মকান্ড শুরু করেছিল। বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের উপর চালাচ্ছিল চরম নির্মমতা। তরুলতা তখন মাধ্যমিকে অধ্যায়নরত। তারা ছিলেন দশ ভাইবোন। তরুলতা বলেন, ‘সনদ অনুয়ায়ী আমার বয়স কমানো আছে। বাস্তবে আমি অনেক দেরিতে বিদ্যালয়ে গেছি। মুক্তিযুদ্ধকালীন আমি একজন যুবতি নারী। আমাকে নিয়ে আমার পরিবার খুব দুঃশ্চিন্তায় ছিল। একপর্যায়ে সকলের প্রাণ বাঁচাতে ও আমার সম্ভ্রম রক্ষার্থে স্বপরিবারে পায়ে হেঁটে ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। পথিমধ্যে বাগআঁচড়া-হলদিপোতা গ্রামে পাকিস্তানি সেনাদের দ্বারা আক্রান্ত হই। ওখানে অনেক বাঙালি শহিদ হন। আমাকে এক পাকিস্তানি সেনা বেয়নেট দিয়ে বোগলের নিচে খোঁচা দেয়। সেই চিহ্ন আজও আছে। আমার বৌদিকে বন্দুকের পেছন দিয়ে জোরে আঘাত করে। বেদম মারপিটের শিকার হই সবাই। প্রচন্ড গোলাগুলির একপর্যায়ে আমার পরিবারের সদস্যরা একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই।’ তরুলতা এদিক সেদিক দৌঁড়াতে দৌড়াতে তাঁর স্কুলের বাংলা শিক্ষক নিরোধ বাবুর দেখা পান। তার সান্নিধ্যে থাকার প্রায় ৭ দিন পর তাঁর বড় দা ও বৌদির সাক্ষাৎ পান। তারা ছিলেন নগ্ন প্রায়। তরুলতার বুঝতে বাকি রইলো না, যে পথিমধ্যে তারা চরম নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এরপর কান্নাকাটি করতে করতে তারা দৌড়াতে দৌড়াতে একপর্যায়ে ভারতে চলে গেলেন। সেখানে গিয়ে হাবড়া বাণীপুর ক্যাম্পে উঠেছিলেন। দীর্ঘদিন সেখানে থাকার পর শরণার্থীদের সন্তানদের গোবর ডাঙ্গা কলেজে লেখাপড়ার সুযোগ করে দিল ভারত সরকার, যাতে তারা পড়াশুনা একেবারে ভুলে না যায়। ঐ কলেজে পড়ার সময় ভবেন্দ্রনাথ সানা ও বিনোদবিহারী বিশ^াস দুজন যারা সম্পর্কে তাঁর দাদা হন। তারা বললেন, ‘তুই মুক্তিযুদ্ধে যেতে চাইলে কোলকাতা গোবরা ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তুই যেতে পারিস।’ প্রতুত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি ভেবে দেখি।’ পরদিন তার কাকারা অর্থাৎ মুক্তিযোদ্ধা চারু বিশ^াস তাঁর চাচাত বোন তারা যে ক্যাম্পে ছিলেন, তরুলতা ঐ ক্যাম্পে যান, সেখানে গিয়ে দেখেন সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী ও তাঁর দল ক্যাম্পে ক্যাম্পে ঘুরে ঘুরে মেয়ে সংগ্রহ করছেন। তাই দেখে তিনি উৎসাহিত হয়ে প্রশিক্ষণে যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। এরপর ভবেন্দ্রনাথ সানা, বিনোদবিহারী বিশ^াস ও তাঁর দাদা মনোরঞ্জন বিশ^াস তাকে গোবরা ক্যাম্পে নিয়ে যান। তাঁর দাদা বনসই দিয়ে তাকে ক্যাম্পে রেখে আসে। এরপর আহত মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা প্রদানের জন্য তরুলতা উক্ত ক্যাম্পে ২/৩ মাস নার্সিং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। মুকুল, লায়লা, শিরিন, খন্দকার রেজাউল করিম নানা বিষয়ে ক্লাস নিতেন ও নার্সিং প্রশিক্ষণ দিতেন। এরপর প্রথম ধাপে ২০ জন মেয়েকে আগরতলা নিয়ে গেলেন। ২য় ধাপের জন্য তাকে বাছাই করেছিলেন। তাঁর সহযোদ্ধা ছিলেন, রঞ্জিতা মন্ডল, বিশা খাঁ বৈরাগী, মাজেদা খাতুন, কৃষ্ণা রহমান, আম্বিয়া শফি, কাঞ্চনসহ অনেকেই।
তরুলতা ক্যাম্পের স্মৃতিচারণ করে আরো বলেন, ‘আমাদের বিভিন্ন খেলাধূলা, গান-বাজনা ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত রাখত। একটি নজরুলগীতি আমরা সমস্বরে প্রায়ই গাইতাম-‘জাগো নারী জাগো বহ্নিশিখা। জাগো স্বাহা সীমন্তে রক্তটিকা।’ কৃষ্ণা রহমান একটি নাটিকা করালেন একদিন, নাটিকাটির নাম-‘বাবা ডাক হুনবোই’।” তিনি বলেন, ‘‘সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী খুব আন্তরিকভাবে খোঁজ-খরব নিতেন। ১৬ ডিসেম্বর যখন দেশ শত্রুমুক্ত হলো মাথার উপর উড়োজাহাজ চলছে। আমরা জানিনা দেশ মুক্ত হয়েছে, খুব ভয় পেয়ে গেলাম। তখন প্রশিক্ষকরা আমাদের বললেন কানে তুলো দিয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়। পরে জানলাম দেশমুক্ত হয়েছে, সবাই আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে লাফ দিয়ে উঠলাম। ১৭ ডিসেম্বর আনন্দ মিছিলে কোলকাতা শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলো প্রদক্ষিণ করলাম। সেদিন আমাদেরকে ধর্মতলায় নিয়ে গেলেন। সরাসরি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে দেখলাম। উঁনি আমাদের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। এরপর ক্যাম্পে ফিরে আসলে আমাদেরকে একটি করে সনদ দেওয়া হলো। আমি হাবড়া বাণীপুর ক্যাম্পে আমার পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে আসলাম।’’
এই নারী যোদ্ধা তাঁর পরিবারের সাথে ডিসেম্বরের শেষের দিকে দেশে ফিরে আসেন। এরপর আবার লেখাপড়ায় মন দেন। তিনি বি.এ পাস করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন।