শিরোনাম |
আমাদের কাছে সত্যিই অন্যরকম এক সকাল আজ। ভোরের আলো ফুটতেই একরাশ আবেগ অনুভূতির পরশে আচ্ছন্ন হওয়ার দিন। স্বপ্ন, সংগ্রাম, সাধনার দীর্ঘ পথযাত্রায় রজত জয়ন্তীর মাইলস্টোনে পৌঁছানো সত্যিই অনন্য এক অর্জন। পরম পাওয়া, পরম সৌভাগ্যেরও। হ্যাঁ পাঠক, গ্রামের কাগজের আজ জন্মদিন। আপনাদের আস্থা ভালোবাসায় ২৫ বছর পূর্ণ করে আজ তার ২৬ শে যাত্রা। এই শুভক্ষণে আমাদের অগণিত পাঠক, দর্শক, শুভানুধ্যায়ী, বিজ্ঞাপনদাতাকে জানাচ্ছি প্রাণঢালা অভিনন্দন।
১৯৯৯ সালের ২৬ মার্চ যাত্রার দিন থেকে এ পর্যন্ত আমরা চেষ্টা করেছি পাঠকের মনের মতো একটি পত্রিকা প্রকাশ করতে। লক্ষ্যে অবিচল থেকেছি বলেই আমাদের প্রতি পাঠকের সেই যে ভালোবাসা শুরু, তা চলছে একাধারে। পাঠকই আমাদের শক্তি, দুর্দিন-সুদিনের সাথী। পঁচিশের মাইলফলকে দাঁড়িয়ে, মাঝে মাঝে মনের অজান্তে প্রশ্ন জাগছে সত্যিই এতদূর আসতে পেরেছিতো? সন্বিৎ ফিরে আবেগে আপ্লুতও হচ্ছি-হ্যাঁ অনেকটা পথ সাফল্যের সাথেই পাড়ি দিতে পেরেছি। নিদারুণ কষ্ট, শ্রম, ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে দিয়ে জীবনের ২৫টি বছরের যে সাধনা; তাতে সফলতার মুখ দেখেছি আমরা। খুলনা বিভাগের প্রথম রঙিন দৈনিক, পদ্মার এপারে প্রথম আট পৃষ্ঠা, প্রথম ই-পেপার, সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফরমে সবার আগে যাত্রা, ঢাকার বাইরে সারাদেশে প্রথম লিখিত সম্পাদকীয় নীতিমালা তৈরি, ভালো ভালো রিপোর্টের জন্যে ঢাকার বাইরে একটি পত্রিকার সাংবাদিকদের সবচেয়ে বেশি পুরস্কার অর্জন-এসব গৌরবই রয়েছে গ্রামের কাগজের। তৃণমূলের নানা সমস্যা, মানুষের দুঃখ-দুর্দশা, আনন্দ-বেদনার ছবি বরাবরই ফুটে উঠেছে গ্রামের কাগজের পাতায়। সমস্যা সমাধানের পথও দেখানো হয়েছে। এখানেই গ্রামের কাগজ দায়িত্ব শেষ করেনি। সামাজিক দায়বদ্ধতার তাগিদে মানবিকতার হাত বাড়িয়ে পাশে দাঁড়িয়েছে অসহায়দের। আগামীর স্বপ্ন দেখিয়েছে অনেককে। এ কারণে সব মহলে নন্দিত হয়েছে গ্রামের কাগজ।
রজত জয়ন্তীর মতো আকাঙ্খার এমন দিনে কিছু মানুষকে আমাদের স্মরণ করতেই হয়। সাবেক বিদ্যুৎ
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী পিতৃতুল্য অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম আর তার সহধর্মীণি আমাদের মাতৃসম নুরুন্নাহার লিলি গ্রামের কাগজকে দাঁড় করাবার এক বড় প্রেরণা ও সাহস। এমপি শেখ আফিল উদ্দিনের সংশ্লিষ্টতায় দক্ষিণাঞ্চলের প্রথম রঙিন দৈনিক হিসেবে গ্রামের কাগজের অগ্রযাত্রায় তার প্রতি রয়েছে আমাদের কৃতজ্ঞতা। যশোরের সৃজনশীল ব্যবসায়ী শ্রদ্ধাভাজন আব্বাস আলী বিশ্বাস, আদ-দ্বীনের নির্বাহী পরিচালক ডা. শেখ মহিউদ্দিন, তৎকালীন এমপি প্রয়াত আলী রেজা রাজু ও খান টিপু সুলতান, জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট শরীফ আব্দুর রাকিব, বীর মুক্তিযোদ্ধা রবিউল আলম, আব্দুল মান্নান, সাবেক এমপি শাহীন চাকলাদার, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান সাইফুজ্জামান পিকুল, সাবেক প্যানেল চেয়ারম্যান আব্দুল খালেক, সাবেক এমপি মনিরুল ইসলাম মনির, প্রয়াত উপজেলা চেয়ারম্যান নূরজাহান ইসলাম নীরা, বর্তমান চেয়ারম্যান মোস্তফা ফরিদ আহম্মেদ চৌধুরী, আওয়ামী লীগ নেতা মোহিত কুমার নাথ, সাবেক মেয়র জহিরুল ইসলাম চাকলাদার রেন্টু, চৌগাছার আওয়ামী লীগ নেতা এসএম হাবিব, আওয়ামী লীগ নেতা মুন্সী মহিউদ্দিন, রবি সিদ্দিকী, আরএন রোডের মুসা ভাই, যশোর বিএনপির প্রয়াত নেতা আনোয়ার হোসেন, আব্দার ফারুকসহ অনেকেই গ্রামের কাগজের শুরুতে গভীর আন্তরিকতায় নানাভাবে সহযোগিতা করেছেন। গ্রামের কাগজের নিজস্ব অফিসটির ব্যবস্থা করেছেন আমাদের মামা অ্যাডভোকেট রবিউল ইসলাম। এরকম আরও অনেক শুভাকাঙ্খী ছিলেন বলেই সামনে এগুতে পেরেছি আমরা। যাত্রার শুরুতে যেসব সাংবাদিক, কর্মী গ্রামের কাগজকে একধাপ এগিয়ে নিয়েছেন তাদের অবদানের জন্য কৃতজ্ঞ আমরা। আর যারা চরম দুঃসময় থেকে এ পর্যন্ত গ্রামের কাগজকে আঁকড়ে ধরে আছেন, তাদের ভালোবাসা-অবদান কোনোকিছুর সাথে তুল্য নয়।
মাটি মানুষের কথা অবিরাম লিখে চলা গ্রামের কাগজ শুধু পাঠক সমাদৃত হয়েছে তাই না, দুর্নীতি অনিয়মের অনুসন্ধানী রিপোর্ট, তথ্য অধিকার আইন, ডিজিটাল বাংলাদেশসহ নানা বিষয়ের প্রতিবেদনে গ্রামের কাগজের গায়ে যুক্ত হয়েছে পুরস্কারের নতুন নতুন পালক। এমনকি এসব সাফল্যের কারণে বিদেশি সংবাদ মাধ্যমেরও শিরোনাম হয়েছে জেলা শহরের এই পত্রিকাটি। প্রসঙ্গক্রমে বলতেই হয়, এসব প্রাপ্তির জন্যে সাংবাদিকদের দক্ষ হয়ে ওঠার কাজটি লাগাতার করেছেন এমআরডিআই’র নির্বাহী পরিচালক হাসিবুর রহমান মুকুর ভাই। সেই ধারাবাহিকতায় গ্রামের কাগজের সুযোগ হয়েছে বিবিসি মিডিয়া অ্যাকশনের সাথে তিন বছর কাজ করার। বর্তমানে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অর্থ সহায়তায় ফ্রিপ্রেস আনলিমিটেড’র অধীনে সাকমিডের সাথে কাজ করছে গ্রামের কাগজ। এর ফলে আমাদের কর্মীরা আরও দক্ষতা বৃদ্ধির পাশাপাশি বিশ্বের বিখ্যাত সাংবাদিক ও মিডিয়ার সাথে সম্পর্ক তৈরির সুযোগ পাচ্ছে। সুশীল সমাজ, সিভিল সোসাইটি অর্গানাইজেশনসহ সমাজে নেতৃত্বদানকারীদের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে জনকল্যাণে কাজ করছে। এসুযোগে গ্রামের কাগজের পাতায় মানসম্মত নানা প্রতিবেদনও উঠে আসছে তাদের হাত দিয়ে।
রজত জয়ন্তীর এ শুভক্ষণে সাফল্যের মণিহারে যেমন ঊজ্জ্বল গ্রামের কাগজ, তেমনি ফেলে আসা দিনগুলোর স্মৃতিকাতরতায় আচ্ছন্ন আমরা। দুঃখ, কষ্ট, সাফল্য, আনন্দ বেদনার মিশেলের দিনগুলো চোখ ভেজাচ্ছে। গ্রামের কাগজের সাব এডিটর কামরুজ্জামান শাওন, ছোট্ট জুয়েল, কাশিপুর প্রতিনিধি জামালউদ্দিন, কালীগঞ্জের মিঠু শিকদার, এক সময়ের নওয়াপাড়া প্রতিনিধি আসলাম হোসেন, ঝিকরগাছা প্রতিনিধি কাজী সামাদ, মোংলার এ কে আজাদ আর বিজ্ঞাপন ম্যানেজার মামুন মোস্তাহিদ চলে গেছেন পরপারে। আজকের দিনে ভীষণ মনে পড়ছে তাদের। পাঠক শুভাকাঙ্খীদের মধ্যেও অনেকের মৃত্যু আমাদের মধ্যে গভীর শূন্যতা এনেছে। প্রতিবছরের এ দিনে যাদের সরব উপস্থিতিতে আমরা নতুন প্রাণ পেয়েছি, যাদের স্পর্শের আলোয় সাহস খুঁজেছি, তাদের অনেককেই চিরতরে হারিয়েছি। গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি তাদের স্মৃতির প্রতি। যারা চরম অসুস্থ আছেন আজকের দিনে তাদের জন্যেও আমাদের শুভকামনা।
পত্রিকা প্রকাশনায় গোটা বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও চলছে চরম ক্রান্তিকাল। নিউজপ্রিন্টসহ অন্যসব উপকরণের মূল্য আকাশছোঁয়া। ছাপা খরচ বেড়েছে কয়েকগুণ। আবার যুদ্ধবিগ্রহ, অস্থিরতায় বৈশ্বিক আর্থিক মন্দার ঝাঁজ লাগছে বিজ্ঞাপন আয়ে। পাশাপাশি উদ্বেগজনকহারে পাঠকও কমছে প্রিন্ট ভার্সনে। সবমিলিয়ে বিপর্যস্ত মিডিয়া সেক্টর। এরমধ্যে টিকে থাকতে লড়াই করতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত। কিন্তু পাঠকের কাছে গ্রামের কাগজের যে দায়বদ্ধতা রয়েছে তাতে সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেই সামনে এগুতে চাই আমরা। টিম গ্রামের কাগজ সে লড়াইয়ে সবসময় প্রস্তুত। অফিস ও তৃণমূলের সংবাদকর্মীরা এক সুতোয় বাধা। তাদের অমিত শক্তিতে ভর করে চলছে নতুন নতুন পরিকল্পনা। গ্রামের কাগজের ডিজিটাল প্ল্যাটফরমকেও আরও দর্শকপ্রিয় করতে চলছে অবিরাম চেষ্টা।
পাঠকের সাথে সবসময় যুক্ত থাকার অঙ্গীকারে আমরা দৃঢ় প্রত্যয়ী। আমরা মনে করি, আস্থা ভালোবাসার দায়বদ্ধতা অসীম। ২৫ বছর ধরে পাঠক শুভাকাঙ্খীর সেই ভালোবাসা আমাদেরকে তাড়িত করেছে বলে বুকের শত কষ্টকে চাপা দিয়ে সামনে এগিয়েছি। কাগজ পরিবারের বন্ধন ছিন্ন করেছে অনেক সদস্য, পরম ভালোবাসা-মমতার সহকর্মীদের মরদেহ কবরে শুইয়ে, কিংবা প্রেসে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে সংবাদ লিখেছি। পরদিন যথারীতি গ্রামের কাগজ পাঠকদের হাতে তুলে দিয়েছি। সেইসব দিনগুলো কখনো ভোলার না।
নতুন দিনের শুরুতে শুধু মনে হচ্ছে, সময় দ্রুত গড়িয়ে যাচ্ছে, এমন আর একটি ২৫ পেরুলেই আসবে সুবর্ণ জয়ন্তী। সেই পঞ্চাশের মাইলস্টোনে আমরা অনেকেই হয়তো পৃথিবীতে থাকবোনা। কিন্তু আমাদের ভালোবাসার গ্রামের কাগজ যেন মাথা উঁচু করে থাকে সৌরভে গৌরবে-এ প্রত্যাশা রজত জয়ন্তীর এই শুভক্ষণে।
লেখক : সম্পাদক, গ্রামের কাগজ