শিরোনাম |
বিভিন্ন সময় লিখতে যেয়ে আমার এটুকু ধারণা হয়েছে গ্রামের কাগজ পাঠকপ্রিয়তা গ্রাম থেকে শহর সকল পর্যায়ে। গ্রামাঞ্চলে অনেকে হয়তো বাড়িতে পত্রিকা রাখেন না। বাজারে যেয়ে পড়ে আসেন কিম্বা অফিসে। কিন্তু পড়েন এমন অনেক মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। কোথাও দেখা হলে তারা আমাকে চেনেন। জিজ্ঞাসা করেন নিয়মিত লিখছি না কেন? তখন লেখার দায়বদ্ধতা চোখে পড়ে। তেমনি একটা বিষয় নিয়ে আজকের লেখা সেই মানুষদের জন্য যাদের একটু সচেতনতা রক্ষা করতে পারে দুর্ঘটনা থেকে অনেক জীবন।
আজকাল রাস্তায় বেরোলেই মোটরসাইকেলের আধিক্য যেভাবে চোখে পড়ে তা মারাত্মক বলা যায়। স্কুল পড়ুয়া থেকে শুরু করে প্রায় সব বয়সের মানুষের যেন প্রধান যানবাহন মোটরসাইকেল। এই বিষয়ে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করতে চাই। উপদেশ নয় নিরেট বাস্তবতার কয়েকটি চিত্র তুলে আনাটা সময়ের প্রয়োজন বলে মনে হয়।
একজন দরিদ্র কৃষকের কথা বলি। বর্গাচাষি, পরের জমি চাষ করেন। হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে উপার্জন করেন। স্বপ্ন দেখেন তার ছেলেরা লেখাপড়া শিখে বড়ো মানুষ হবে। ছেলে এসএসসি পরীক্ষার আগে বায়না ধরে মোটরসাইকেল কিনে দিতে হবে। নাহলে পরীক্ষা দেবে না। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে শেষমেশ পরীক্ষা দেয়। পাশ করে মোটরসাইকেল না দিলে পড়াশোনা, খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে জেদ করার একপর্যায়ে বাবা বাধ্য হয়ে ছেলের পছন্দমতো সাইকেল কিনে দেয়। স্টাইলিশ ছেলে মোটরসাইকেল চালিয়ে কলেজে যায়। বেশ ভালোই লাগে দেখতে! কিন্তু 'বিধি হাসে মুচকি পরিহাস'! দুইমাসের মাথায় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলাকে ধাক্কা দিলে মহিলা গুরুতর আহত হয় এবং দুইদিন পরই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। দরিদ্র কৃষকের অবস্থা সহজেই অনুমেয়। থানা, পুলিশ, কোট-কাচারি করতে করতে বাবা বেচারা কপর্দকশূন্য।
এমনি আরও একটা পরিবারের কথা জানি। বেশ অভাবগ্রস্থ, যাকে বলে টানাটানির সংসার। দুটো ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করে। ছেলেটা এবার কলেজে উঠেছে। হঠাৎ শুনি ছেলে মোটরসাইকেল চালিয়ে বেড়াচ্ছে। জানা গেল ছেলেটির মা তার বাবার বাড়িতে যে জমি ভাগে পেয়েছে তা তিন লাখ টাকা বিক্রি করে ছেলেকে দুই লাখ টাকা দিয়ে মোটরসাইকেল কিনে দিয়েছে। আর একলাখ দিয়ে ঘরে টিন দিয়েছে। মা ডিম, মুরগী বিক্রি করে সাইকেলের তেল কিনে দেয় আর ছেলে স্টাইল করে এঁকেবেঁকে মোটরসাইকেল চালিয়ে বেড়ায়।
এরকম গল্প বিস্তর শোনা এবং দেখা যায় রাস্তায় বেরোলেই। স্কুলশিক্ষক বাবা পায়ে হেঁটে স্কুলে যায়, ছেলে মোটরসাইকেলের মডেল চেঞ্জ করে প্রতিবছর, নয়তো কলেজে মান থাকে না। কয়েকদিন আগের পত্রিকার খবর-- ছেলে মোটরসাইকেল না পেয়ে আত্মহত্যা করতে যাওয়ায় বাবা ভয় পেয়ে সাইকেল কিনে দেওয়ার দুইদিন পরই দুর্ঘটনায় ছেলেটা মারা যায়। এরকম অসংখ্য ঘটনা ঘটে চলেছে গত কয়েক বছর ধরে। সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেলে মৃত্যুর পরিসংখ্যান দেখলেই তা বোঝা যায়। যে সংখ্যায় মোটরসাইকেল নিয়ে তরুণদের রাস্তায় দেখা যায় তার কতগুলি কাজের প্রয়োজনে তাদের হাতে দেওয়া হয় তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। বাবা দিনমজুরি করে তেলের দাম জোগান দেয় আর ছেলে হিরোগিরি করতে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে নিজে মরে, অন্যকে মারে অথবা ভেঙেচুরে পঙ্গু হয়। ধনীদের বিলাসিতার কথায় না যাই! তারা হয়তো সখ করে ছেলেকে মোটরসাইকেল কিনে দেন। বেশ হিরো হিরো লাগে দেখতে এবং তা দেখেও সুখ যতক্ষণ না ছেলে ভেঙেচুরে বা লাশ হয়ে ফিরে আসছে। কথাগুলো কানে ধাক্কা লাগালেও অবস্থাদৃষ্টে নিদারুণ সত্যি।
অকালমৃত্যু একটি পরিবারকে নিঃস্ব করে দেয়। এই অপূরণীয় ক্ষতির কোনো বর্ণনা হয় না। আগেকার দিনে পরিবারে সন্তান সংখ্যা বেশি থাকায় কেউ বায়না ধরে বড়ো কোনো জিনিস চাওয়ার সুযোগ ছিল না। বাবা-মায়েরাও এসব তেমন গ্রাহ্য করতেন না। এখন বাবা-মায়ের একটা দুটো সন্তান। সঙ্গত কারণেই তারা সবেধন নীলমনি। তারাও জানে তাদের বায়না উপেক্ষা করার সাহস বাবা-মায়ের নেই। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। সর্বস্ব দিয়ে ছেলের আবদার পূরণ করার পরে যদি ছেলেকেও হারাতে হয় তাহলে এর চেয়ে দুঃখের আর কী হতে পারে!
এমনিতেই রাস্তাঘাটের বেহাল দশা সর্বত্র। রাস্তায় গরমে পিচ গলে যায়, বৃষ্টিতে পিচ ধুয়ে পাথর বালি বেরিয়ে পড়ে, উঁচু নিচু এ্যাবড়োথেবড়ো রাস্তায় এমনিতেই গাড়ি চালানো ঝুঁকিপূর্ণ। আর নতুন মোটরসাইকেল হাতে পাওয়া জেনারেশন তো গতি কমাতে জানে না। গতি কমালে স্টাইল ঠিকঠাক জমে না। তাই অভিভাবকদের উদ্দেশ্যে অনুরোধ আপনারা আর একটু সচেতন হোন, এদের বাঁচাতে আর একটু কৌসুলি হোন।
শহরের ভিতরের চিত্র আরও বেশি ভয়াবহ। রিকশা, ইজিবাইক, মোটরসাইকেল একটা আরেকটার ওপর দিয়ে গেলে ভালো হয়। কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ফুটপাতগুলো ফুচকাওয়ালা, ফলওয়ালা বা অন্যান্য ভ্যান ব্যবসায়ীদের দখলে। এক পা হাঁটার জায়গা নেই। ফুটপাত ফাঁকা থাকলে শহরের ছোটো ছোটো প্রয়োজন মানুষ পায়ে হেঁটেও সারতে পারে। তাতে অর্থসাশ্রয় এবং মানুষ শারীরিক ভাবে সুস্থ থাকতে পারে। শহরের আয়তন অনুযায়ী যানবাহনের সংখ্যা নির্ধারণ হওয়া উচিত বলে মনে হয়। তাহলে এমন বিশৃঙ্খলা হয়তো কিছুটা কম হতো।
মানুষের জীবন নিরাপদ হওয়ার লক্ষ্যকে মাথায় রেখে আমাদের সকল উন্নয়ন কর্মসূচি হাতে নেওয়া উচিত। সকল মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হোক এমনটাই শুভকামনা।