শিরোনাম |
একাত্তরের জননী রমা চৌধুরীর জন্মবার্ষিকী আজ। মাত্র তিন বছর বয়সে বাবা রোহিনী চৌধুরীকে হারান। রোহিনী বাবুকে হারিয়ে পরিবারের স্বচ্ছল অবস্থার করুণ পরিস্থিতি তৈরি হলেও রমা চৌধুরীর মা মোতিময়ী চৌধুরী থেমে থাকার মানুষ ছিলেন না। মোতিময়ী চৌধুরী শত বাধা পেরিয়ে তাঁকে পড়াশোনা জন্যে অনুপ্রেরণা দিয়ে যান। মায়ের অনুপ্রেরণায় ১৯৫২ সালে মাত্র ১১ বছর বয়সে বোয়ালখালীর মুক্তকেশী গার্লস হাইস্কুল থেকে এসএসসি এবং ১৯৫৬ সালে কানুনগোপাড়া কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।
তিনি ১৯৫৯ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। মায়ের উৎসাহ ও উদ্দীপনায় ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। ষাটের দশকে তখন নারীদের উচ্চশিক্ষা এতো সহজ ছিল না। সেই সময় রমা চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তিনিই দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রথম নারী, যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। পড়াশোনার প্রতি তাঁর আগ্রহ ছিল প্রবল।
রমা চৌধুরী ১৪ অক্টোবর, ১৯৪১ সালে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী থানার পোপাদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা রোহিনী চৌধুরী। মা মোতিময়ী চৌধুরী।
রমা চৌধুরী ১৯৬২ সালে কক্সবাজার বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে পূর্ণাঙ্গ কর্মজীবন শুরু করেন। পরে দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি বিভিন্ন উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষিকার দায়িত্ব পালন করেন। শিক্ষকতার মধ্য দিয়ে চলতে চলতে তিনি বৈবাহিক জীবনে আবদ্ধ হন। এরই মধ্যে আসে উনিশো একাত্তর, স্বাধীনতা যুদ্ধ।
১৯৭১ সালের ১৩ মে ভোরে তিনি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে নিজ বাড়িতে নির্যাতনের শিকার হন। সম্ভ্রম হারানোর পর পাকিস্তানি দোসরদের হাত থেকে পালিয়ে পুকুরে নেমে আত্মরক্ষা করেছিলেন। হানাদাররা গানপাউডার লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয় তার ঘরবাড়িসহ যাবতীয় সহায়-সম্পদ। তিনি তার উপর নির্যাতনের ঘটনা একাত্তরের জননী নামক গ্রন্থে প্রকাশ করেন। ঘরবাড়িহীন বাকি আটটি মাস তাকে তিনটি শিশুসন্তান আর বৃদ্ধ মাকে নিয়ে জলে-জঙ্গলে লুকিয়ে বেড়াতে হয়েছে। রাতের বেলায় পোড়া ভিটায় এসে কোনোমতে পলিথিন বা খড়কুটো নিয়ে মাথায় আচ্ছাদন দিয়ে কাটিয়েছেন। এসব ঘটনার বিবরন পাওয়া যায় তার লেখা একাত্তরের জননী গ্রন্থে।
১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের আগের রাতে ১৫ ডিসেম্বর থেকে শ্বাসকষ্ট শুরু হয় তার সন্তান সাগরের। ২০ ডিসেম্বর রাতে মারা যায় সাগর। একাত্তরের জননী গ্রন্থের ২১১ পৃষ্ঠায় রমা চৌধুরী লিখেছেন, “ঘরে আলো জ্বলছিল হ্যারিকেনের। সেই আলোয় সাগরকে দেখে ছটফট করে উঠি। দেখি তার নড়াচড়া নেই, সোজা চিৎ হয়ে শুয়ে আছে সে, নড়চড় নেই। মা ছটফট করে উঠে বিলাপ ধরে কাঁদতে থাকেন, `আঁর ভাই নাই, আঁর ভাই গেইয়্যে গোই” (আমার ভাই নেই, আমার ভাই চলে গেছে)। একই অসুখে আক্রান্ত দ্বিতীয় সন্তানও। ১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি অর্ধউন্মাদিনী রমা চৌধুরী নিজের ছেলে টগরকে ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে অসাবধানতাবশত তার শ্বাসরোধ হয়ে যায়। এতে মারা যায় টগর। প্রথম সংসারের পরিসমাপ্তির পরে দ্বিতীয় সংসার বাঁধতে গিয়ে প্রতারণার শিকার হন। দ্বিতীয় সংসারের ছেলে টুনু ১৯৯৮ সালের ১৬ ডিসেম্বর বোয়ালখালীর কানুনগোপাড়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান।
স্বাধীনতার পরে ২০ বছর তিনি লেখ্যবৃত্তিকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন। প্রথমে তিনি একটি পাক্ষিক পত্রিকায় লিখতেন। বিনিময়ে সম্মানীর বদলে পত্রিকার ৫০টি কপি পেতেন। সেই পত্রিকা বিক্রি করেই চলত তার জীবন-জীবিকা। পরে নিজেই নিজের লেখা বই প্রকাশ করে বই ফেরি করতে শুরু করেন। প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা মিলিয়ে তিনি নিজের ১৮টি গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন।
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ : একাত্তরের জননী, ১০০১ দিন যাপনের পদ্য, আগুন রাঙা আগুন ঝরা অশ্রু ভেজা একটি দিন, ভাব বৈচিত্রে রবীন্দ্রনাথ, অপ্রিয় বচন, লাখ টাকা, হীরকাঙ্গুরীয়।
রমা চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের পর টানা চার বছর জুতো পরেননি। এরপর নিকটজনের পীড়াপিড়িতে অনিয়মিতভাবে জুতো পরা শুরু করলেও তৃতীয় সন্তান মারা যাবার পর আবার ছেড়ে দিয়েছেন জুতো পায়ে দেয়া। এরপর রমা চৌধুরী ১৫ বছর ধরে জুতো ছাড়াই চলেন।
রমা চৌধুরী দেশের প্রতিটি জেলায় একটি করে অনাথ আশ্রম খুলতে চেয়েছিলেন। সকল ধর্মের অনাথরা সেই আশ্রমে থাকবে। মনুষ্য দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে তারা কর্মজীবনে প্রবেশ করবে। তিনি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন প্রতিনিয়ত।
২০১৩ সালে শেখ হাসিনার আগ্রহে রমা চৌধুরী তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে রমা চৌধুরী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। খালি পায়ে তার সাথে সাক্ষাতে নিজের কষ্টের কথা জানান। শেখ হাসিনা আর্থিক সহযোগিতা করতে চাইলে রমা চৌধুরী বিনয়ের সঙ্গে তা ফিরিয়ে দেন। বরং উল্টো তাকে উপহার দিয়ে এসেছিলেন নিজের লেখা “একাত্তরের জননী” গ্রন্থটি।
সবকিছু হারিয়ে একরকম নিঃস্ব হয়েছেন তিনি। জীবনের দীর্ঘ সময় পার করে ফেলেছেন এখন এই আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে তিনি কিইবা করবেন তাই কোনো ধরনের আর্থিক সহযোগিতা গ্রহণ করেননি। নিজের সন্তানেরা শহীদের মর্যাদা পায়নি, কিন্তু তাঁর কাছে ওরা শহীদ। এই কথাটি তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন।
একাত্তর রমা চৌধুরীকে দিয়েছে পোড়া ভিটে, কাঁধের ঝোলা, ছেলের শোক আর খালি পা। এই নিয়েই ছিল রমা চৌধুরীর দিনযাপন।
একাত্তরের বীরাঙ্গনা রমা চৌধুরী ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে পড়ে গিয়ে কোমর ভেঙে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। দীর্ঘদিন ধরে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হাড়ের ব্যথাসহ নানা রোগে ভোগার পর ২০১৮ সালের ৩রা সেপ্টেম্বর সোমবার ভোররাত ৪টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
ছবি ও তথ্য – ইন্টারনেট