শিরোনাম |
❒ সরকার মোটা অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে
❒ বহুতলের আবেদন পড়ে আছে ৩৫৬টি
যশোর জেলার ইউনিয়ন পর্যায়ে বছরের পর বছর প্লান অনুমোদন ছাড়াই নির্মিত হচ্ছে একতলাসহ বহুতল পাকা ভবন। এদের অনেকেই জানেন না, প্লান অনুমোদন নিতে হয়। আবার অনেকে জেনেও ইচ্ছা করেই অনুমোদন চাননি ইউনিয়ন পরিষদের প্রত্যয়ন ও উপজেলায় কাগজপত্র দেয়ার ঝামেলায়। আবার কয়েক বছর উপজেলায় আবেদন পড়ে থাকায় প্লান অনুমোদন বিমুখ হয়েছেন অনেকেই।
সব মিলিয়ে জেলায় গত ৫ বছরে অনুমোদন ছাড়াই একতলা ও বহুতল মিলিয়ে ৫ হাজার পাকা বাড়ি নির্মিত হয়ে গেছে। আবার উপজেলাগুলোতে পড়ে আছে সহস্রাধিক আবেদন। এর মধ্যে যশোর সদর উপজেলায় পড়ে আছে ৩৫৬টি আবেদন। অনুমোদন না পাওয়ায় অনেকে ব্যাংক ঋণ সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছেন। আবার প্লান অনুমোদন ছাড়াই নির্মাণ হয়ে যাওয়ায় সরকার বিশাল অংকের রাজস্ব হারিয়েছে।
যদিও উপজেলা প্লান কমিটির পক্ষে বলা হয়েছে, বিগত সময়ে ঠিকমত মিটিং না হওয়া, প্রচারণা কম থাকাসহ নানা কারণে সংকট তৈরি হয়েছে। দ্রুত তার উত্তরণ ঘটিয়ে এ সংক্রান্ত সভা করে প্লান অনুমোদন দেয়া হবে।
২০ বছর আগেও যশোরাঞ্চলের গ্রামগুলো ছিল সবুজে ভরপুর। সবুজ ক্ষেতের পাশ ধরে ঝিরি ঝিরি বাতাসে মেঠোপথ দিয়ে হাঁটার অভিজ্ঞতা থেকে দূরে চলে এসেছে যশোরের মানুষ। গ্রামগুলোও আজ শহরের দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ছে। অপরিকল্পিতভাবে গ্রামের আনাচে-কানাচে গড়ে উঠছে ঘরবাড়ি। এমনকি যশোরের একশ্রেণির অর্থ ও প্রভাবশালী লোকজন গ্রামের সুবিশাল সবুজ মাঠ কমমূল্যে কিনে সেখানে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলছেন কলকারখানা। ধানী জমির পরিমাণ কমে যাচ্ছে। তাছাড়া অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতার কারণে গ্রামের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে সবাই বাড়ি পাকা করার দিকে ঝুঁকছেন। এখানে পাকা বলতে বাড়িগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ইটের দেয়াল এবং ওপরে টিনের দ্বারা তৈরি হচ্ছে। এমনকি দুই তিন তলা বাড়িও যশোরের গ্রামগুলোতে খুব সহজলভ্য বিষয়। কিন্তু এক্ষেত্রে নির্মাণ বিধিমালা মানা হচ্ছে না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। তাছাড়া যশোরের উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদগুলো গ্রামাঞ্চলে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা তদারকি করে না বললেই চলে।
যশোর সদর উপজেলা প্রশাসন সূত্র জানিয়েছে, বিধি অনুযায়ী পাকা ভবন নির্মাণের আগে ইউনিয়ন পরিষদের অনাপত্তি প্রত্যয়ন ও প্লানসহ উপজেলা প্রশাসনের কাছে লিখিত আবেদন করতে হবে। এর সাথে সরকারের নির্ধারিত ফি কোষাগারে জমা দিতে হয়। এজন্য ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছ থেকে প্রত্যয়নপত্র নিয়ে হয়। পৌরসভার বাইরে গ্রামে বসতঘর নির্মাণের আগে এই সরকারি নির্দেশনা ও বিধি-বিধান জারি আছে। পাকা ও আধাপাকা ভবন নির্মাণের আগে উপজেলা প্রশাসন থেকে অনুমোদন নেয়ার নিয়ম উপেক্ষা করেই যশোরের গ্রামগুলোতে নির্মাণ করা হচ্ছে এসব বসতবাড়ি।
তথ্য মিলেছে, যশোরের ৮ উপজেলার ৯৩ ইউনিয়নের ১ হাজার ৪শ’৮৭ গ্রামে গত ৫ বছরে পাঁচ হাজারেরও বেশি পাকা ভবন নির্মাণ হয়েছে প্লান অনমোদন ছাড়াই। চলতি বছরেও নির্মাণের হিড়িক রয়েছে। তবে সরকারি অনুমোদনের তোয়াক্কা না করেই নির্মাণ করছেন ভবন মালিকরা। আবার অনেকে অনুমোদনের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ থেকে প্রত্যয়ন নিয়ে জমা দিলেও আবেদন পড়ে থাকছে। যে কারণে এতে ব্যাংক ঋণসহ সরকারি সুযোগ-সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছেন তারা। এমনকি নির্মাণ ত্রুটিসহ কোনো অঘটন হলে আইনি জটিলতায়ও পড়বেন তারা।
সূত্রের দাবি, উপজেলা প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের নিয়ে বসতবাড়ির প্লান অনুমোদন বিষয়ক একটি কমিটি আছে। তবে ঠিকমত ও সময়মত ওই কমিটির সভা না হওয়ায় অনুমোদন মিলছে না। উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদ অধীক্ষেত্রাধীন এলাকায় ইমারত/স্থাপনার নকশা অনুমোদন এবং ভবনের গুণগতমান নিশ্চিতকরণে যে কমিটি রয়েছে তাতে উপজেলা চেয়ারম্যান সভাপতি। তবে এখন উপজেলা নির্বাহী অফিসার চার্জে থাকায় তিনিই সভাপতি। এই কমিটির সদস্য সচিব উপজেলা প্রকৌশলী, সদস্য সহকারী কমিশনার (ভূমি), ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানগণ, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্সের প্রতিনিধি, ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেসের প্রতিনিধি, ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানারসের প্রতিনিধিসহ আরো দুই জন। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগের ১৯৯৩ সহ অন্যান্য প্রচলিত বিধি-বিধান অনুসরণ করে সর্বোচ্চ ৭তলা ভবন ৭৫ ফুট পর্যন্ত নকশা অনুমোদন করতে পারবে এই কমিটি। প্রতি ৩ মাস অন্তর এই কমিটির ন্যূনতম একটি সভা করবে বলে নিয়ম থাকলেও গত ৫ বছরে যশোরে তা যথাযথভাবে কার্যকর হয়নি। আর যশোর সদর উপজেলায় গত ৩ বছর কোনো সভা হয়নি। যে কারণে শুধু যশোর সদর উপজেলায় ৩৬টি আবেদন পড়ে আছে। কোনো সিদ্ধান্ত না আসায় কালক্ষেপন করে অনেকে নির্মাণ কাজ শুরু করে দিয়েছেন। উপজেলার ১৫ ইউনিয়নে গত ৫ বছরে প্লান অনুমোদন ছাড়াই নির্মিত হয়েছে কমপক্ষে ৬শ’ পাকা ভবন। একদিকে আবেদন করলেও মিলছে না অনুমোদন। আবার অনেকে আবেদন করছেনই না। সব মিলিয়ে একটি সংকট তৈরি হচ্ছে। যাতে সরকার মোটা অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে।
তথ্যানুযায়ী, অনুমোদন ফি প্রতি স্কয়ার ফিট দ্ইু টাকা করে। সে হিসেবে ১ হাজার স্কয়ার ফিট থেকে শুরু করে ২১শ’ স্কয়ার ফিটের একতলা থেকে ৪/৫ তলা পর্যন্ত বাড়ি ঘর তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন বাজারে বহুতল ভবন বেশি তৈরি হয়েছে। জেলায় এর সংখ্যা ৫ হাজারেরও বেশি গত ৫ বছরে। হাতে গোনা কিছু অনুমোদন নিলেও বেশিরভাগে অনুমোদন নেই। আর বিশাল অংকের রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। উপজেলা কমিটির গড়িমসির কারণে এই পরিস্থিতি বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। আবার স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানদের তদারকির অভাবকেও দায়ী করছেন অনেকে। কেউ কেউ অনুমোদন নিতে গিয়ে ভোগান্তির অভিযোগও তুলেছেন।
অনুমোদ ছাড়াই একতলা ও বহুতল ভবন নির্মাণকারীদের অনেকে জানিয়েছেন তারা বাড়ি নির্মাণে অনুমোদনের বিষয়ে জানতেন না। আবার অনেকে জেনেও গড়িমসি করেছেন। কেউ বলেছেন, গ্রামে নতুন ঘর নির্মাণে সরকারি অনুমোদন নিতে হয় তা জানা ছিলো না। স্থানীয় রাজমিস্ত্রি দিয়ে ঘর নির্মাণ করেছেন। এ বিষয়ে কেউ তদারকিও করতে আসেননি।
সুজলপুর গ্রামের এম আইউব জানিয়েছেন, পাকা ভবন নির্মাণ করেছি। কেউ জিজ্ঞাসা করতে আসেননি। এখন শুনছি নির্মাণ ত্রুটিসহ কোনো অঘটন ঘটলে আইনি জটিলতায় পড়তে হবে। ব্যাংক ঋণসহ সরকারি সুযোগ-সুবিধাও পাওয়া যাবে না। এখন ইউনিয়ন থেকে যোগাযোগ করে উপজেলা থেকে অনুমোদন নেবো।
হাসিমপুরের ইমামুল হাসান জানিয়েছেন, বাড়ি নির্মাণের আগে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে অনাপত্তিপত্র নিয়েছি। এখন শুনছি উপজেলা পরিষদের অনুমোদনও নিতে হবে। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব অনুমোদনের জন্য আবেদন জমা দেবো।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরবপুর ইউনিয়নের এক বাসিন্দা জানিয়েছেন, ইউনিয়ন পরিষদ থেকে অনাপত্তিপত্রের পর উপজেলা পরিষদে প্ল্যানসহ আবেদন জমা দিয়েছি ৬ মাস আগে। শুনেছি গত ৩ বছর প্লান অনুমোদন কমিটির সভা হয় না। তার আবেদনসহ ৩৫৬টি আবেদন পড়ে আছে। উপজেলা পরিষদ থেকে অনুমোদন পেতে দীর্ঘ সময় লাগে। এতে আবেদনকারীরা অনেক ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
যশোরের রামনগর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মাহমুদ হাসান লাইফ জানিয়েছেন, বাড়ি মালিকদের অধিকাংশই প্রত্যয়ন নেয়ার ব্যাপারে উদাসীন। আবার গ্রাম পর্যায়ে নতুন বসতঘর নির্মাণে অনুমোদন নিতে হয় তা অনেকেই জানেন না। তারা স্থানীয় মিস্ত্রি ডেকে ঘর নির্মাণ করছেন। গ্রামে বাড়ি নির্মাণে অনুমোদনের তোয়াক্কা নেই। গত দুই বছরে তার দপ্তরে মাত্র ৭ টি আবেদন জমা পড়েছে প্রত্যয়নের জন্য। অনেক কাগজপত্র জমা দিতে হয় এ কারণে এড়িয়ে চলেন বেশিরভাগ মানুষ। আর শ’ শ’ বাড়ি হচ্ছে প্রত্যয়ন ও অনুমোদন ছাড়াই।
এ ব্যাপারে যশোর সদর উপেজলা নির্বাহী অফিসার শারমিন আক্তার দৈনিক গ্রামের কাগজকে জানিয়েছেন, তিনি নতুন যোগদান করেছেন। প্লান অনুমোদনের জন্য তার দপ্তরে অনেক আবেদন জমা হয়ে আছে। বিগত সময়ে প্লান কমিটির সভা না হওয়ায় ওগুলো জমা আছে। তার যোগদানের পরও প্লান অনুমোদন কমিটির সভা হয়নি। এ ব্যাপারে তিনি উপজেলা প্রকৌশলীর সাথে কথা বলেছেন। দ্রুততম সময়ের মধ্যে সভা করে অনুমোদন দেয়া শুরু হবে। যে কোনো পাকা স্থাপনা প্ল্যান মাফিক নির্মাণ করতে হয়। সেখানে গ্রাম পর্যায়ে প্লান ছাড়া ও অনুমোদন না নিয়েই স্থাপনা নির্মাণ ঝুঁকিপূর্ণ। এ বিষয়ে ভবন নির্মাণ কমিটির কার্যক্রম জোরদারে উদ্যোগ নেয়া হবে।
উপজেলা প্রকৌশলী চৌধুরী আসিফ রেজা দৈনিক গ্রামের কাগজকে জানিয়েছেন, তিনি যশোরে সদ্য যোগদান করেছেন। কিছু আবেদন উপজেলা চেয়ারম্যানের দপ্তরে কিছু উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দপ্তর রয়েছে। আবেদনগুলো এক জায়গায় করা হচ্ছে। বিগত সময়ে প্লান অনুমোদন কমিটির সভা না হওয়ায় আবেদনের জট পড়েছে। আগামি মাসেই এ সংক্রান্ত কমিটির সভা করা হবে এবং যাচাই-বাছাই করে অনুমোদন দেয়া হয়। দ্রুত প্লান অনুমোদন কার্যক্রম শুরু হবে। প্লান ছাড়া বাড়ি নির্মাণ করলে পড়ে যেকোনো ধরনের আইনী জটিলতায় পড়তে হবে। এজন্য বাড়ির মালিকদের অনুমোদনের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিতে হবে।