gramerkagoj
বৃহস্পতিবার ● ১৬ জানুয়ারি ২০২৫ ২ মাঘ ১৪৩১
gramerkagoj
Ad for sale 100 x 870 Position (1)
Position (1)
এক প্রজন্মের একাল সেকাল (২য় পর্ব)
প্রকাশ : মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর , ২০২৪, ০৮:৪৭:০০ পিএম , আপডেট : মঙ্গলবার, ৩১ ডিসেম্বর , ২০২৪, ১০:০১:০৩ এএম
মাহমুদা রিনি:
GK_2024-12-31_67740465df637.jpg

আমি পঞ্চাশ দশক পরবর্তী গ্রামীণ জনপদের পরিবেশ উল্লেখ করছি। যে সময় এখনকার মতো পিচঢালা রাস্তা, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, শিক্ষার জন্য এত স্কুল কলেজ ছিল না। সেই সময় প্রত্যন্ত গ্রাম এলাকায় লেখাপড়ার পরিবেশ কম থাকলেও মোটামুটি সচল ছিল। মুসলিম গৃহস্থ পরিবারের প্রায় সকল শিশুই মাদ্রাসা বা মক্তবে আরবি শিখতে যেত। অধিকাংশ পরিবার কৃষিনির্ভর এবং তাদের সন্তানরাও ছোটো থেকে কৃষিকাজে সম্পৃক্ত হতো। মোটামুটি সচ্ছল পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের লেখাপড়া শেখাতে চাইতো। তখন যারা লেখাপড়া শিখেছে তাদের বেশ পরিশ্রম করেই লেখাপড়া শিখতে হয়েছে। প্রাইমারি স্কুল কাছাকাছি থাকলেও হাইস্কুল ছিল বেশ দূরে দূরে। খালি পায়ে দুএক মাইল হেঁটে সেই সময় স্কুলে যাওয়া ছিল সাধারণ ব্যাপার। কলেজে পড়তে তখনকার সময় গ্রামের অধিকাংশ ছাত্র শহর অঞ্চলের বাসাবাড়িতে লজিং থাকতো ঐ বাড়ির ছেলেমেয়ে পড়ানোর বিনিময়ে।
শহরাঞ্চলে লেখাপড়ার পরিবেশ যথেষ্ট উপযোগী ছিল এবং ইচ্ছা করলে ছাত্ররা টিউশনি বা অন্য কাজের পাশাপাশি পড়াশোনা করতেও পারতো। জেলা শহরগুলোতে কর্মজীবী ছাত্রদের জন্য নৈশবিদ্যালয় বা কলেজ ছিল যেখানে দিনে কাজ করে রাত্রে পড়াশোনা করার সুযোগ ছিল। গ্রাম বা শহর সবখানেই শিক্ষকগণ ছিলেন তেমনি প্রজ্ঞাবান এবং ধৈর্যশীল। অধিকাংশ শিক্ষক সাদাসিধা দরিদ্র পরিবারের হলেও ছাত্রদেরকে সন্তান জ্ঞানে শিক্ষা দিতেন। ছাত্ররাও শিক্ষকদেরকে পিতৃজ্ঞানে সম্মান করতো। তুলনামূলক ভাবে মেয়েদের শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল সত্যি অপ্রতুল। সেসময় গ্রাম থেকে ছেলেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বা উচ্চ শিক্ষার সুযোগ পেলেও মেয়েদের জন্য সে উপায় ছিল না। শহরের মেয়েদের জন্য শিক্ষার সুযোগ সুবিধা থাকলেও গ্রামাঞ্চলে মেয়েরা অনেক পিছিয়ে ছিল। গ্রামের মেয়েরা মক্তবে আরবি শিখতে যেত। কিন্তু লেখাপড়ার ক্ষেত্রে দরিদ্র পরিবারের মেয়েরা প্রায় নিরক্ষর ছিল। অবস্থাপন্ন পরিবারের মেয়েরা স্কুলে যেত কিন্তু অধিকাংশ মেয়েরই ক্লাস এইট, নাইন বা বড়ো জোর এসএসসি পরীক্ষার পরপরই বিয়ে হয়ে যেত। দু'একজন মেয়ের পরিবার শহরে আত্মীয় স্বজন থাকলে হয়তো তাদের বাসায় রেখে কলেজে ভর্তি করতে সাহস করতো। শহরে বিয়ে হলে স্বামী, শ্বশুরবাড়ির সহযোগিতা পেলে কেউ কেউ পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ হয়তো পেতো কিন্তু সেটা কালেভদ্রে। দুঃখের বিষয় যে সেই অবস্থার খুব বেশি উন্নতি এখন পর্যন্ত হয়নি। এখনো বাল্যবিবাহ হয়। মেয়েরা লেখাপড়া শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াবে এই স্বপ্ন বাবা-মায়েরা তখন যেমন ভাবতে পারতেন না, এখনো অধিকাংশ বাবা-মায়েরা ভাবতে পারেন না।
বিদ্যুৎবিহীন জীবন আমরা এখন ভাবতে পারি না কিন্তু তখনকার জীবন ছিল প্রায় প্রাকৃতিক আলো নির্ভর। প্রাকৃতিক এই কারণে বলা যে আলো নির্ভর কাজ সব দিনের বেলায় করে রাখতো গ্রামের মানুষ! ঘর গৃহস্থালিতে রাতের কাজ, লেখাপড়া সহ অন্য সব কাজে ব্যবহৃত হয়েছে কেরোসিনের ল্যাম্প বা হ্যারিকেন। মায়েরা রান্নাবান্না করতেন ল্যাম্পের আলোয়। ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করেছে হ্যারিকেন জ্বালিয়ে। সন্ধ্যাবেলা প্রতি বাড়িতে ল্যাম্প, হ্যারিকেন মোছা ও ধরানো ছিল নিত্যদিনের কাজ। বিশেষ করে বাড়ির মেয়েরা এই কাজ বেশি করতো।
সকল প্রকার উৎসব পালিত হতো সারা গ্রামের মানুষের একাত্মতায়। প্রতিবেশীর বাড়িতে খাবার বিতরণ সহ সবার বাড়ি যেয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করা ছিল প্রতিটি উৎসবের অংশ। ঈদের সময় ঈদগাহ ময়দানে মেলা বসতো। ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েরা এমনকি কিশোরী মেয়েরাও নতুন জামাকাপড় পরে ঈদগাহ ময়দানে বেড়াতে যেত। পর্দাপ্রথার কড়াকড়ি তখন এত বেশি চোখে পড়তো না। মহিলারা শাড়ি পরতেন সুন্দর করে। বিশেষ করে বিয়ের পর শাড়িই ছিল একমাত্র পোশাক। শাড়ি পরেই আমাদের মায়েরা চমৎকার পর্দায় থাকতেন। কখনো শাড়ীর উপর একটা ওড়না পরতেন। দুএক জন মুরুব্বি স্থানীয় নানি-দাদিকে দেখেছি কোথাও গেলে বোরকা পরতে। শহরে চাকরিজীবী নারী স্বল্পসংখ্যক থাকলেও গ্রামাঞ্চলে তখন ছিলই ছিল না বলা যায়। এখনো এই সংখ্যা বেশি না হলেও নারীর বাইরে চলাচল অনেক বেড়েছে। পুরুষেরা বেশির ভাগ লুঙ্গি- ফতুয়া বা হাওয়াই শার্ট পরতো, বিশেষ সময়ে বা প্রয়োজন অনুযায়ী পাঞ্জাবি-পাজামা ও শার্ট- প্যান্ট পরতেন। ছেলেমেয়েরা খালি পায়ে স্কুলে যেত। পোশাক পরিচ্ছদের এত ফ্যাসন তখন গ্রাম এলাকায় পৌছায়নি। আমাদের এক প্রজন্ম আগে মানে নানা- দাদাদের সময় পর্যন্ত মোটামুটি অবস্থাপন্ন পরিবারের পুরুষেরা ধুতি পাঞ্জাবীও পরতেন।
বাড়িতে অতিথির সমাগম ছিল অনেক বেশি। আত্নীয়, অনাত্মীয় বা মোটামুটি পরিচিত এমনকি অপরিচিত মানুষও প্রয়োজনে একবেলা আতিথ্য গ্রহণ করতে পারতেন। অতিথি আপ্যায়নে তেমন আড়ম্বর না থাকলেও আতিথেয়তা ছিল আন্তরিকতাপূর্ণ। গ্রামে সপ্তাহে দুদিন হাট বসতো, এছাড়া পুকুর- নদীর মাছ, উৎপাদিত শাকসবজি, পোষা হাঁস-মুরগির ডিম এসব দিয়ে সাধারণ গৃহস্থ পরিবারের চাহিদা পূরণ হয়ে যেত। বিশেষ প্রয়োজনে বাড়ির পোষা হাঁস-মুরগি দিয়েই সাধারণত মেহমানদারি সারা হতো। গরু, খাসির মাংস খুব কাছে সচারাচর পাওয়া যেত না, দূরের বাজার থেকে আনতে হতো, সেটা সাধারণত কালেভদ্রে মিলত। মাছের চল ছিল খুব বেশি। বাজার ছাড়াও নিজস্ব পুকুর, বাঁওড়, নদী,খাল-বিলে প্রচুর মাছ পাওয়া যেত। দেশি মাছের কোনো অভাব ছিল না। বর্ষাকালের জমে থাকা পানি শুকিয়ে গেলে আসেপাশে জলা, ডোবা বা নিচু ক্ষেতে প্রচুর মাছ জমা হতো। পাড়ার ছেলেমেয়েরা দল বেঁধে পানি সেঁচে সেখান থেকে মাছ ধরতো। 'মাছে ভাতে বাঙালি' কথাটা হয়তো এইজন্যই। হাটের দিন মিষ্টির দোকানে বিক্রি হতো প্রচুর। দানাদার, গজা, জিলিপি, রসগোল্লা ছিল প্রধান আকর্ষণ। অধিকাংশ মানুষ হাটের দিনগুলোতে কোনো না কোনো মিষ্টি কিনে আনতেন বাড়ির ছেলেমেয়েদের জন্য। এছাড়া ছোটোখাটো অনুষ্ঠানের জন্য মিষ্টি বাজার থেকে আসলেও বড়ো অনুষ্ঠান, বিয়ে বা যে কোনো কাজে বাড়িতেই ময়রাদের ভিয়েন বসতো। এখনকার মতো ডেকোরেটর ব্যবস্থা তখন ছিল না। গ্রামে প্রতিবেশীরা সবাই মিলে রান্নার আয়োজন করতো। পাড়ার মুরুব্বিদের মধ্যে কেউ কেউ এই ব্যাপারে বিশেষজ্ঞ ছিল। যত বড়ো অনুষ্ঠান হোক এনারা নিজেদের দক্ষতায় পরিচালনা করতেন। তরুণ, যুবকরা তাদের সহযোগিতা করতো। এভাবেই গ্রামের বিয়ে বা যে কোনো বড়ো আয়োজন হেসে খেলে সম্পন্ন হতো।
শিশুদের খেলাধুলার অবকাশ ছিল অশেষ এবং উন্মুক্ত। ধরাবাঁধা কোনো নিয়মে তারা বাঁধা ছিল না। স্কুল থেকে ফিরে সূর্যাস্ত পর্যন্ত তারা অবাধে খেলাধুলা করে বেড়াতো। উপকরণের এতো প্রাচুর্য না থাকলেও শিশুরা হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তাই দিয়েই খেলার উপকরণ বানিয়ে নিত। বাতাবি লেবু বা খড় পেচিয়ে ফুটবল, কঞ্চি দিয়ে ডাংগুলি, ডাল বা কাঠের টুকরো দিয়ে ক্রিকেট ব্যাট ইত্যাদি। এছাড়াও কানামাছি, গাদি, বউচি, গোল্লাছুট এগুলো ছিল ছেলেমেয়েদের নিত্যদিনের খেলা। পুকুর, বাওড়ের পানিতে সাঁতার কাটা, উপর থেকে পানিতে ঝাপিয়ে পড়া আরও কত কী করে তাদের দিন শেষ হতো। কিশোর, তরুণদের জন্য ফুটবল খেলার টিম ছিল গ্রামে গ্রামে। স্থানীয় স্কুলমাঠে প্রতিযোগিতামূলক খেলা অনুষ্ঠিত হতো যা এখনো প্রচলিত।
এখন কৃষি কাজে গরুর ব্যবহার কমে গেলেও তখন গরুই ছিল কৃষিকাজের প্রধান মাধ্যম। চাষের জন্য জমি তৈরি করতে লোহার ফলাযুক্ত লাঙ্গলের সাথে হালের গরু জুড়ে দিয়ে চাষ করে। এছাড়াও ফসল জমি থেকে বাড়িতে আনা, মাড়াই করা এসব কাজে গরুর গাড়ি ব্যবহার হতো, যা এখনো হয়তো দুএক জায়গায় চোখে পড়ে। গৃহস্থ বাড়িতে গরু- ছাগল, হাঁস-মুরগি থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কৃষক পরিবারে হালের বলদ ছাড়াও দুধেল গাভী থেকেছে। গরুর দুধ জ্বাল দিয়ে গৃহিণীরা সর তৈরি করতেন এবং সেই সর হাতে মেখে তৈরি হতো মাখন। মাখন জ্বাল দিয়ে ঘি বানানো হতো। বাড়িতে তৈরি সেই ঘি-এর স্বাদ ছিল মনে রাখার মতো।
--------------চলবে

আরও খবর

Ad for sale 225 x 270 Position (2)
Position (2)
Ad for sale 225 x 270 Position (3)
Position (3)
🔝