শিরোনাম |
১৯৭১ সালের ১৪ই জুন পর্যন্ত কমরেড অমল সেন ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল)-র সদস্য । কমরেড অমল সেন ১৯৭০ সালের অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বাকড়ির পদ্মলোচন রায়ের বাড়ি থেকে গ্রেফতার হন। কমরেড অমল সেন জীবনে বহুবার গ্রেফতার হয়ে কারারুদ্ধ থেকেছেন। কিন্তু ১৯৭০ সালের গ্রেফতার এবং যশোর ক্যান্টনমেন্টে তার উপর কী নির্যাতন হয়েছিল তা কমরেড অমল সেনের লেখা থেকে উল্লেখ করলাম-
“ইংরেজ চলে গেল। কিন্তু প্রধানত ওই তেভাগার মধ্যে থাকার অপরাধেই? আমাকে ১৯টি বছর মুসলিম লীগের জেলে বিনা বিচারে থাকতে হলো। তারপর ইয়াহিয়ার আমলে এসে ওদের সামরিক ছাউনিতে নিয়ে যেয়ে আমাকে তেভাগা দেওয়ার নাম করে শরীরের রন্ধ্র বিশেষের (মলদ্বারে) মধ্যে ঝালের গুড়া পিচকারী দিয়ে গায়ের ঝাল মিটাতে চাইলো।”
অমল সেন গ্রেফতার হওয়ার পর আরও গ্রেফতার হয়েছিলেন বাকড়ি গ্রামের প্রবীণ স্কুল শিক্ষক প্রয়াত গোকুল বিশ্বাস, অভয়নগরের জয়রাবাদ আমতলা অঞ্চলের শিক্ষক বৈদ্যনাথ বিশ্বাস ও তৎকালীন নড়াইল শহরের অ্যাডভোকেট গোলাম মোস্তফা।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ বাঙ্গালি জাতি ও জনগণের উপর পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরোচিত হিংস্র আক্রমণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র জাতীয় প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য ইপিসিপি (এম-এল)-র নড়াইলের নেতাকর্মীরা ২৭শে মার্চ সকাল ১১টার মধ্যে নড়াইল ট্রেজারির অস্ত্রভান্ডারের দখল নিয়ে নেয়। এরমধ্যে ৯০ ভাগ অস্ত্র ইপিসিপি (এম-এল)-র হস্তগত হয় বাকি ১০ভাগ অস্ত্র আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হাতে যায়। ২৮শে মার্চ যশোর শহরের ট্রেজারির অস্ত্র একইভাবে ইপিসিপি (এম-এল)-র কর্মীদের হস্তগত হয়। নড়াইলে ট্রেজারির অস্ত্র দখলে নেতৃত্ব দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর লোহাগড়ার নূর মোহাম্মদ সাহেব, শহীদ মমতাজ উদ্দীন, সাঈফ হাফিজুর রহমান খোকন, মিজানুর রহমান, শরিফ মুনির হোসেন, মফিজুর রহমান, আফসার উদ্দিন, সৈয়দ মাহবুবুর রশিদ, এডভোকেট এমরান, সর্দার জহির উদ্দিন, জিল্লুর রহমান, আসাদুজ্জামান, জহুরুল হক, জহিরুল কামালসহ আরো অনেকে।
যশোর শহর ও নড়াইলের পার্টি সদস্য ছিল হাতেগোনা। আমি পাকিস্তান সরকারের মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নিয়ে ১৯৭০ সালের মার্চ মাস থেকে আত্মগোপনে ছিলাম। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ আমি বড়েন্দার গ্রামে প্রয়াত কমরেড বামাচরণ গোলদারের বাড়িতে ছিলাম। ২৬ শে মার্চ সন্ধ্যায় বেতবাড়িয়ার কমরেড জ্ঞান সরকারের বাড়িতে কমরেড মমতাজ, তবিবুর রহমান (মনু জমাদ্দার) প্রমুখ আমার সঙ্গে দেখা করে। ২৯শে মার্চ ইপিআর বাহিনী ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী ও আমাদের পার্টি নেতা-কর্মীরা যৌথভাবে যশোর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। ঝুমঝুমপুরে বিহারীরা তাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে এবং ক্যান্টনমেন্ট থেকে রকেট লাঞ্চারের গোলাবর্ষণ করে। ওই সময়ে অনেক বিহারী স্বতঃস্ফূর্ত জনগণের হাতে নিহত হয়। সেখান থেকে হাজার হাজার মানুষের মিছিল যশোর শহরে ঢুকে ঘোপ এলাকায় অবস্থিত যশোর কারাগারের দিকে অগ্রসর হয়। শেষ পর্যন্ত কারাগার আক্রমণ করে কমরেড অমল সেন, বৈদ্যনাথ বিশ্বাস, এডভোকেট সৈয়দ গোলাম মোস্তফা ও বাকড়ি স্কুলের গোকুল বিশ্বাসকে মুক্ত করে মিছিল সহকারে তাঁদেরকে নিয়ে এগারোখানের বাকড়ি স্কুলে এসে হাজির হয়।
১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকবাহিনী বাঙালি জাতি ও জনগণের উপর আক্রমণ শুরু করলে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)র যশোর জেলা কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল-
১. পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে জাতীয় প্রতিরোধ গড়ে তোল।
২. গ্রামাঞ্চলে শ্রেণিশত্রু খতমের লাইনকে ত্বরান্বিত কর।
৩. মুক্তাঞ্চল গড়ে তোল।
সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় উপস্থিত ছিলেন সম্পাদক হেমন্ত সরকার, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য সুধাংশু দে ও শামসুর রহমান। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)র কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক মণ্ডলীর ২রা এপ্রিলের সভায় যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল-
১. পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে জাতীয় প্রতিরোধ গড়ে তোল।
২. গ্রামাঞ্চলে পাক-বাহিনীর দালালদের খতম করে জনগণের প্রতিরোধ গড়ে তোল।
৩. পার্টির নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোল।
৪. আওয়ামী লীগের সঙ্গে সাময়িক মিত্রতার সম্পর্ক গড়ে তোল।
৫. পার্টির প্রভাবিত মুক্তাঞ্চল গড়ে তোল।
সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় উপস্থিত ছিলেন সম্পাদক সুখেন্দু দস্তিদার, সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য তোয়াহা ও আব্দুল হক। কেন্দ্রীয় সম্পাদকমণ্ডলীর এই প্রস্তাব তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য শৈলকুপা থানার ও ঢাকার নারায়ণগঞ্জের শ্রমিক নেতা হাবিবুর রহমানের মাধ্যমে ৪ঠা এপ্রিল তারিখে যশোর জেলা কমিটির হাতে পৌছায়। মাগুরার তৎকালীন পার্টির নেতা অধ্যাপক মো. মাহফুজুল হক নিরোর মাধ্যমে এই চিঠি পৌছেছিল তৎকালীন যশোর জেলা পার্টির হেডকোয়ার্টারের তৎকালীন অন্যতম নেতা শামসুর রহমানের বাড়িতে। ১৯৭১ সালের ১১ই এপ্রিল তারিখে পুলুম থানার কাটি গ্রামে তৎকালীন পার্টি সদস্য আবুল কালামের বাড়িতে জেলা কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই জেলা কমিটির সভায় কমরেড অমল সেনকে বিশেষ ভাবে উপস্থিত থাকতে বলা হয়েছিল। জেলা কমিটির সভায় যাঁরা উপস্থিত ছিলেন তাঁরা হলেন কমরেড হেমন্ত সরকার, কমরেড সুধাংশু দে, কমরেড শামসুর রহমান, কমরেড খবির উদ্দীন ও আমি। বিশেষ ভাবে উপস্থিত ছিলেন কমরেড অমল সেন। জেলা কমিটির সদস্য কমরেড মহিউদ্দীন আলী আখতার অনুপস্থিত ছিলেন।
কমরেড অমল সেন অক্টোবর মাসে গ্রেফতারের আগে খুলনা জেলার কমরেড শচীন বসুকে শ্রেণিশত্রু খতমের লাইনের বিরুদ্ধে লেখা কমরেড অমল সেনের লিখিত বক্তব্যটি পাঠিয়েছিলেন। পুলুম পার্টি হেডকোয়ার্টার থেকে খুলনায় পার্টির ডাক ব্যবস্থা ছিল যথাক্রমে পুলুম, ডুমুরতলা (কখনো কখনো), গোবরা, অভয়নগর, ফুলতলার পাশে দামোদর গ্রমে প্রয়াত কমরেড কামরুজ্জামান লিচুর বাসায়। কমরেড শচীন বোসের সাথে কমরেড অমল সেনের সম্পর্ক ছিল সশস্ত্র বিপ্লবীদের সংগঠন অনুশীলন সমিতির সময়কাল থেকে। পরবর্তীকালে কমিউনিস্ট পার্টির আমলেও কারাগারের বাইরে থাকাকালীন সময়ে কমরেড শচীন বোসের সাথে চিন্তা, দৃষ্টিভঙ্গি ও পদ্ধতিতে মিল ছিল এবং ছিল গভীর সম্পর্ক। কমরেড অমল সেনের কমরেড শচীন বোসকে পাঠানো এই চিঠি দামোদর থেকে ফেরত পাঠানো হয়। গোবরা অঞ্চলে পার্টির এই যোগাযোগ রক্ষার মূল দায়িত্ব পালন করতেন এগারোখানের বাকড়ি গ্রামের গোবরা পার্ব্বতী বিদ্যাপীঠের বিজ্ঞানের শিক্ষক কমরেড সন্তোষ মজুমদার। কমরেড সন্তোষ মজুমদার জেলা কমিটির সদস্য হিসাবে আমাকে ঐ চিঠি দিলে খাম না খুলেই আমি পাঠিয়ে দিলাম জেলা কমিটির সম্পাদক কমরেড হেমন্ত সরকারের কাছে। ১১ এপ্রিলের জেলা কমিটির সভায় তৎকালীন পরিস্থিতি ও করণীয় সম্পর্কে জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর তিন দফা প্রস্তাব ও কেন্দ্রীয় সম্পাদক মণ্ডলীর পাঁচ দফা প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়।
আমার যতদূর মনে পড়ে এসব আলোচনায় কমরেড অমল সেন নির্বাক ও নিশ্চুপ ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে তিনি কেন পার্টি শৃঙ্খলার বাইরে পাশের জেলার কমরেড শচীন বোসকে কমরেড অমল সেনের কৌশলগত বক্তব্যের কপি পাঠালেন? এই আলোচ্যসূচি যখন আলোচনার জন্য উত্থাপন করা হলো তখনো কমরেড অমল সেন ছিলেন নিশ্চুপ। জেলা কমিটির অন্য সদস্যরাও কমরেড অমল সেনকে কেউ কোনো সমালোচনা করেননি। শুধুমাত্র কমরেড শামসুর রহমান বলেছিলেন কমরেড অমল সেনের কাছ থেকে এধরনের কাজ প্রত্যাশিত ছিল না। জেলা কমিটির ওই সভা থেকে কমরেড অমল সেনকে শালিখা থানার ছাবড়ি গ্রামে বিশ্রামের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এখানে জেলা নেতৃবৃন্দের কারোরই কমরেড অমল সেনের প্রতি সামান্যতম শ্রদ্ধার ঘাটতি আমি দেখি নাই। কমরেড অমল সেন ১৯৭১ সালের ১৩ই জুন তৎকালীন পার্টির কাউকে কিছু না জানিয়ে ভারতে চলে যান। এখানে এ বক্তব্য বলার বিশেষ কারণ হলো পরবর্তীতে এধরনের কথা শুনেছি ওই সভায় কমরেড অমল সেনকে সাংঘাতিকভাবে হ্যাকল করা হয়েছিল। যা আলোচনা হয়েছিল তাতে অমল সেন মানসিকভাবে আহত হয়েছিলেন এভাবেও দেখার সুযোগ রয়েছে। অমল সেনের সাথে জেলা কমিটির নেতৃবৃন্দের চিন্তার মৌলিক তফাৎ হতে পারে কিন্তু কমরেড অমল সেনের প্রতি পরবর্তীতেও আমি কোনো অশ্রদ্ধার কথা নেতৃবৃন্দের কারোর কাছ থেকে কখনো শুনি নাই।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে বলতে হয়, ১৯৭২ সালে বাকড়ির কমরেড ভূষণ রায়ের বাড়িতে এক রাজনৈতিক আলোচনায় কমরেড জাকির হোসেন হবি বলেছিল কমরেড অমল সেন তো নয়া সংশোধনবাদী। কমরেড হেমন্ত সরকার কমরেড জাকির হোসেন হবিকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন, কমরেড অমল সেন বাসুদা'কে কী চেন? এসব কথা আমার সামনে কখনোই উচ্চারণ করো না।
১৯৭১ সালের ১৩ই জুন কমরেড অমল সেন ভারতে চলে যাওয়ার খবরে এবং বিশেষ করে না বলে যাওয়ার জন্য মনে মনে বেশ কষ্ট পেয়েছিলাম। পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে ইপিসিপি এমএলের বৃহত্তর যশোর জেলার বিস্তৃত অঞ্চলব্যাপী যে ঘাঁটি গড়ে তুলেছিল ওই সকল ঘাঁটি দখলের জন্য মুক্তিবাহিনী ও মুজিববাহিনী আগস্ট মাসের শেষ থেকে আক্রমণ শুরু করে এবং অনেকক্ষেত্রে অঞ্চলে পর অঞ্চল দখল নিতে শুরু করে । অবশেষে ১৯৭১ সালের ৩১শে অক্টোবর পেড়লী অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পিছু হটে নভেম্বরের তিন তারিখে বনখলিশাখালী গ্রামে ইপিসিপিএমএলের বাহিনী অবস্থান নেয় এবং সেখানে সিদ্ধান্ত হয় যে যেভাবে পারো বাঁচার চেষ্টা করো। বাহিনী আকারে অস্তিত্ব রাখা যাবে না। তাই ১৯৭১ সালের ৬ই নভেম্বর মহেশপুর থানার গরীবপুর বর্ডার পার হই। বীড়গ্রামের কমরেড বিষ্টু দর্জি আমাদের চারজনকে নিয়ে নদীয়া জেলার এক গ্রামে দরিদ্র এক পরিবারের বাড়িতে উঠেন। ভারতে নিয়ে যাওয়ার জন্য শুধু পরামর্শই নয় উদ্যোগী ভূমিকা নিয়েছিলেন কমরেড বিষ্টু দর্জি। বিষ্টু দা' আমাকে বলেছিলেন, কমিউনিস্ট আন্দোলনে যশোর জেলার কোনো বীজ রাখতে চাইলে আমার কথা শোন ও আমার সাথে চল্। যে বাড়িতে গিয়ে আমরা উঠলাম তাদের আন্তরিকতা ও আতিথেয়তার কোনো ঘাটতি ছিল না। ভাত আর মুলো ছেচকি খেয়েই আমরা দুইদিন ওই বাড়িতে ছিলাম। ৭ই নভেম্বর তারিখে কমরেড অমল সেন ওই বাড়িতে এসে হাজির হন। কিভাবে খবর পেলেন তা বলতে পারবো না। তিনি কিছু খোঁজ-খবর নিয়ে ও আমাদের কথাবার্তা শুনে চলে যান। আমরা চারজন ছিলাম কমরেড নুর মোহাম্মদ, কমরেড আবু বকর জাফরুদ্দৌলা দীপু, আমি ও শুধাংশু রায়। নদীয়া থেকে আমি ও নুর মোহাম্মদ ভাই পশ্চিম বাংলার কংগ্রেস নেতা প্রয়াত সৌমেন মিত্রের কাকা ডুন মিত্রের গড়িয়াহাটের বাসায় গিয়ে উঠলাম। কারণ ওই বাসায় ছিলেন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক বিনয় মিত্র ও তাঁর পরিবার। ডুন মিত্রের ছোট ভাই বিনয় মিত্র তাঁর পরিবারসহ ছিলেন। বিনয় মিত্রের মেজো ছেলে মিহির মিত্র, মেয়ে লতু, শীতু এরা ছিল পার্টির প্রতি সহানুভূতিশীল।
আমাকেও যথেষ্ট মাত্রায় হৃদয় দিয়ে শ্রদ্ধা করতো। বিনয় মিত্রের বড় ছেলে অপূর্ব মিত্র ছিল আমার স্কুলজীবনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কমরেড আবু বকর জাফরুদ্দৌলা দীপু চলে যান নারিকেল ডাঙায় তাঁর খালাতো বোনের বাসায়। কমরেড শুধাংশু রায় চলে যান তার শরণার্থী মা-বাবার কাছে।
কমরেড অমল সেন ও কমরেড নজরুল ইসলাম মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ভারতে জাতীয় মুক্তি সমন্বয় কমিটি গঠনে উদ্যোগী ভুমিকা নিয়েছিলেন। ওই সমন্বয় কমিটি গঠনে আরও উদ্যোগী ভুমিকা নিয়েছিলেন পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটির নেতা কাজী জাফর আহমেদ, রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রণো। পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির একাংশের নেতা দেবেন শিকদার ও আবুল বাশার জাতীয় মুক্তি সমন্বয় কমিটির গঠনে উদ্যোক্তা ছিলেন। যখন তথাকথিত পিকিংপন্থী দল ও গ্রুপের মধ্যে স্বাধীনতা যুদ্ধে ইতিবাচক ভুমিকা গ্রহণ করার পরিবর্তে নানা ধরনের বিভ্রান্তির মধ্যে ছিল ঠিক সেই সময়ে কমরেড অমল সেন স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিলেন এই কারণে সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান রাষ্ট্রের পরিবর্তে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লড়াই ছিল প্রগতিশীল । ১৯৮০ সালে আমি কারাগার থেকে বের হওয়ার পর যশোরের এগারোখানের অরবিন্দ বিশ্বাসের ষষ্ঠীতলাপাড়ার বাসায় কমরেড অমল সেনের সাথে একযুগ পরে সাক্ষাত হয়। যদিও গ্রেফতারের আগপর্যন্ত কমরেড অমল সেন লেনিনবাদী পার্টি পত্রিকা বাকড়ি গ্রামে আমার আশ্রয়স্থল ভুষণ রায়ের বাড়িতে রেখে দিতেন। আমিও লেনিনবাদী পার্টির পত্রিকা পড়ার মধ্য দিয়ে তাদের আদর্শিক রাজনৈতিক অবস্থান বুঝার চেষ্টা করতাম। তিন ঘণ্টা আলোচনায় প্রধানত আমার চিন্তা ভাবনা সম্পর্কেই জানতে চান। আমি তিনঘণ্টার মধ্যে দীর্ঘ সময় নিয়ে আমি যে পার্টিতে থাকা অবস্থায় কারুরুদ্ধ হয়েছিলাম সেক্ষেত্রে সেই পার্টির নীতি কৌশল সম্পর্কে কমরেড অমল সেন যেমন ভুল মনে করতেন আমিও ১৯৭২ সাল থেকে ভুল মনে করতাম। আমি ঐদিন আলোচনায় যে নীতি কৌশলের ভ্রান্তির গাড্ডায় পড়েছিলাম সেটি যেমন উল্লেখ করি ঠিক তেমনি ভাবে সেদিন কমরেড অমল সেনের কাজী জাফরের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার সমন্বয় কমিটির নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের উদ্যোগকে মেনে নিতে পারি নাই একথা নির্দ্বিধায় বলেছিলাম। কমরেড অমল সেন ছিলেন আমার বক্তব্যের ব্যাপারে ছিলেন নিশ্চুপ। সবমিলিয়ে কমরেড অমল সেনের রাজনৈতিক জীবনে সবসময় সঠিক অবস্থান নিতে পেরেছেন তা যেমন মনে করি না তেমনি আমি যত প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতার সাথে মিলে সারাজীবন ধরে পার্টি করেছি সেক্ষেত্রে কমরেড অমল সেনের তত্ত্বগতজ্ঞান ও অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে অনেক কিছু শেখার রয়েছে বলে আগেও মনে করতাম, এখনো মনে করি।
# লেখক: রাজনীতিবিদ ও লেখক