শিরোনাম |
❒ দুধ, খাদ্য ও মানবিক সহায়তা প্রবেশে বাধা
❒ আন্তর্জাতিক মহলের নীরবতায় ক্ষুব্ধ গাজা কর্তৃপক্ষ
একদিকে ধ্বংসস্তূপ, অন্যদিকে অনাহারে কাতর শিশু—এটাই আজকের গাজার প্রতিচ্ছবি। গাজার স্বাস্থ্য ও মিডিয়া দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, চলমান ইসরায়েলি অবরোধ এবং লাগাতার বিমান হামলার মধ্যেই ৬৬ শিশু অপুষ্টিজনিত কারণে প্রাণ হারিয়েছে। এ ঘটনাকে ‘ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পিত শিশু হত্যাকাণ্ড’ বলে আখ্যা দিয়েছে গাজার স্থানীয় কর্তৃপক্ষ।
পাশাপাশি, বিশ্ব সম্প্রদায়ের নির্লিপ্ততা নিয়েও উঠে এসেছে তীব্র সমালোচনা। প্রশ্ন উঠেছে—এই মৃত্যুগুলো কি প্রকৃত অর্থে অনিবার্য ছিল? নাকি এগুলো মানবসৃষ্ট রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের করুণ পরিণতি?
গত প্রায় নয় মাস ধরে চলমান ইসরায়েলি অবরোধের ফলে গাজার আকাশ, স্থল ও সমুদ্রপথ সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ। খাদ্য, পানি, চিকিৎসা সামগ্রী, এমনকি শিশুদের প্রয়োজনীয় দুধ পর্যন্ত প্রবেশ করতে দেওয়া হচ্ছে না।
আরও পড়ুন...
দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বৃষ্টির পূর্বাভাস
গাজার মিডিয়া দপ্তরের বিবৃতিতে বলা হয়, “এই অবরোধ কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটি একটি পূর্বপরিকল্পিত, নিষ্ঠুর ও কাঠামোগত হত্যার পদ্ধতি—যেখানে শিশুদের ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।”
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ জানিয়েছে, শুধুমাত্র ২০২৫ সালের মে মাসেই ৬ মাস থেকে ৫ বছর বয়সী অন্তত ৫,১১৯ শিশুকে তীব্র অপুষ্টির কারণে চিকিৎসা দিতে হয়েছে।
এই সংখ্যা গত এপ্রিল মাসের তুলনায় ৫০ শতাংশ এবং ফেব্রুয়ারির তুলনায় ১৫০ শতাংশ বেশি। এদুয়ার বেইগবেদার, ইউনিসেফের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার আঞ্চলিক পরিচালক বলেন, “মাত্র ১৫০ দিনের ব্যবধানে ১৬ হাজার ৭০০-এর বেশি শিশু অপুষ্টির চিকিৎসা পেয়েছে। অথচ প্রতিটি মৃত্যুই প্রতিরোধযোগ্য ছিল।”
তিনি আরও বলেন, “এই শিশুরা মারা যাচ্ছে মানবসৃষ্ট নীতিনির্ধারণের কারণে—খাদ্য ও সহায়তা সীমান্তেই আটকে আছে।”
গাজা কর্তৃপক্ষ এই অবরোধ ও মানবিক সংকটের জন্য শুধু ইসরায়েল নয়, বরং যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির মতো পশ্চিমা শক্তিগুলোকেও দায়ী করছে। তাদের অভিযোগ, এসব রাষ্ট্র ইসরায়েলকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থন দিচ্ছে, এবং জাতিসংঘ কার্যত ব্যর্থ হয়েছে একটি মানবিক করিডোর গড়ে তুলতে।
স্থানীয়রা বলছেন, “আমাদের শিশুদের চোখের সামনে ক্ষুধায় কষ্ট পেতে হচ্ছে, চিকিৎসার অভাবে মারা যেতে হচ্ছে, আর দুনিয়া চুপ করে তাকিয়ে আছে।”
শুধু খাদ্যের অভাবই নয়, গাজার মানুষের জীবন আরও দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে লাগাতার ইসরায়েলি হামলায়। শনিবার গাজায় চালানো বিমান হামলায় অন্তত ৬০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে, যার মধ্যে ৯ জন শিশু রয়েছে।
গাজার তুফাহ এলাকায় টানা দুটি বিমান হামলায় একাধিক আবাসিক ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। স্থানীয় বাসিন্দা মাহমুদ আল-নাখালা বলেন, “হঠাৎ অজানা নম্বর থেকে ফোন আসে— বলা হয় এলাকা খালি করতে। তারপরই পুরো ব্লক ধ্বংস হয়ে যায়। আমার পরিবারের সবাই ধ্বংসস্তূপের নিচে।”
আরও পড়ুন...
ইসরায়েলি হামলায় ৮১ ফিলিস্তিনি নিহত, আহত ৪০০’র বেশি
গাজাবাসীর ভাষ্যে স্পষ্ট যে, এ সংকট শুধু যুদ্ধের নয়, এক গভীর মানবিক ব্যর্থতারও প্রতিচ্ছবি। ক্ষুধার্ত শিশু, ধ্বংসপ্রাপ্ত হাসপাতাল, বিশুদ্ধ পানির সংকট, জ্বালানি না থাকায় অচল হয়ে যাওয়া আইসিইউ—সব মিলিয়ে একটি ধ্বংসপ্রায় সমাজ।
একজন চিকিৎসক বলেন, “শিশুদের চোখে আমি ক্ষুধার্ত মৃত্যু দেখি—এটা শুধু একেকটি মৃত্যু নয়, বরং মানবতা নামক ধারণাটির মৃত্যু।”
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই সংকট সমাধানে জরুরি আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। অবিলম্বে একটি মানবিক করিডোর গড়ে তোলা, সীমান্ত উন্মুক্ত করে খাদ্য, পানি ও ওষুধ প্রবেশ নিশ্চিত করা—এই পদক্ষেপগুলোই পারবে মৃত্যুর মিছিল ঠেকাতে।
জাতিসংঘ ও আরব লীগের যৌথ প্রচেষ্টায় একটি যুদ্ধবিরতির উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বারবার ব্যর্থ হচ্ছে।
৬৬টি শিশু মারা গেছে। হাজারো শিশু আজও মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে। প্রশ্ন জাগে—এই সংখ্যা কি আরও বাড়বে? বিশ্ব কতটি শিশুর মৃত্যু দেখলে গাজা নিয়ে সত্যিকারের নড়েচড়ে বসবে?
এই মুহূর্তে প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, এবং সাহসী আন্তর্জাতিক নেতৃত্ব—যা শিশুদের জীবন রক্ষা করবে, গাজাকে আবার বাঁচতে দেবে।