শিরোনাম |
কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টিতে যশোরের চৌগাছা উপজেলার ফুলসারা ইউনিয়নের একাধিক গ্রামের ফসলি জমি পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এমনকি ঘরবাড়ি হাঁটু সমান পানি কিংবা তারও বেশি পানিতে নিমজ্জিত। এতে অনেকে ঘরছাড়া হয়ে আশ্রয় নিয়েছেন অন্যত্র। মাঠের ধান, বীজতলা তলিয়ে রয়েছে পানির নীচে। ভেসে একাকার হয়ে গেছে বিঘার পর বিঘা মাছের ঘেরসহ পুকুর।
এদিকে, পানিবন্দি মানুষ দুরবস্থার মধ্যে চরম দুশ্চিন্তায় থাকলেও শহরের বিলাসী মানুষ মজা নিতে ভিড় করছেন পানিবন্দি এলাকায়। এলাকার মানুষ যখন তাদের শেষ আশ্রয়স্থলে বসবাস করতে পারছেন না, ধান রোপণ নিয়ে রয়েছেন মহা দুশ্চিন্তায়, তখন এইসব অসহায় মানুষের সামনে অনেকে ‘কক্সবাজার’ বা ‘কুয়াকাটা’ বলে মেতে উঠছেন সেলফি যুদ্ধে। এই পরিস্থিতিতে পানিবন্দি মানুষের কষ্ট আরও বাড়িয়ে তুলছে।
সরজমিন দেখা গেছে, সলুয়া, রানীয়ালূ, হাউলি, বাড়িয়ালী, দুড়িয়ালী, দশপাখিয়া, কালিয়াকুড়িসহ অনেক গ্রামের মাঠের ফর মাঠ পানিতে তলিয়ে রয়েছে। পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় এই জলবদ্ধতা বলে স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ। তারা বলেন, ছোট ছোট কালভাট ও খালগুলো সময়মতো খনন করা হলে এই জলবদ্ধতার সৃষ্টি হতো না।
ভোরের দিকে কৃষক আব্দুল মালেক দাঁড়িয়ে ছিলেন ডুবে যাওয়া মাছের ঘেরের পাশে। পানির নিচে হারিয়ে যাওয়া তার স্বপ্নের দিকে তাকিয়ে শুধু বললেন, ‘এই ঘেরটাই ছিল ভরসা। ধার করে মাছ ছেড়েছিলাম। সব গেলো। এখন খালি পানি আর কান্না।’
তবে সেই পানির পাশে এখন লোকজনের ভিড়। কেউ সেলফি তুলছেন, কেউ ভিডিও করে পোস্ট দিচ্ছেন ফেসবুকে। কেউ লিখছেন চৌগাছার কক্সবাজারে ঘুরতে এলাম।
বাড়িয়ালী গ্রামের কৃষক আমিন বলেন, ‘আমাদের এবার মরণ ছাড়া উপায় নেই। ভারী বৃষ্টিতে এলাকার মাঠের পর মাঠ তলিয়ে রয়েছে। হাজার হাজার বিঘা জমিতে এবার আর ধান চাষ করা সম্ভব হবে না’।
তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, পানিবন্দি মানুষগুলো যখন অসহায়ের মতো জীবনযাপন করছেন তখন তাদের সামনেই একশ্রেণির মানুষ সেলফি তোলা নিয়ে ব্যস্ত। এটা রীতিমতো অশ্লীলতা।
শিমুল হোসেন নামে এক যুবকের কাছে ঘুরতে আসার কারণ জানতে চাইলে তিনি হেসে বললেন, ‘অসাধারণ একটা সৌন্দর্য! পানির মধ্যে ঘরবাড়ি, গাছের মাথা দেখা যাচ্ছে, দেখতেই মন ভালো হয়ে যায়। এমন জায়গা তো সবসময় দেখা যায় না’!
তবে পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা গ্রামবাসী রাবেয়া খাতুন বললেন, ‘আমরা ডুবে যাচ্ছি, তারা এসে ছবি তোলে। কারও কান্না এখানে কারও হাসির বিষয় হয় কিভাবে’। তার কথা বলার সময় চোখের পানি গড়িয়ে পড়তে দেখা গেছে।
এই চিত্র যেন দুই পৃথিবী একপাশে হারানোর বেদনায় ডুবে থাকা মানুষ, আর অন্যপাশে সেই বেদনার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কারও আনন্দ ভ্রমণ।
স্থানীয় সমাজকর্মী আহসান হোসেন বললেন, ‘মানুষ এখানে আসতে পারে, কিন্তু যেন অন্তত একটু সহমর্মিতা থাকে। যারা ভাসছে, তাদের কষ্টটাও যেন দেখা হয়।’
আসলে আমরা কীভাবে এমন পরিস্থিতির দিকে তাকাই, তা-ই বলে দেয় আমাদের মন কতটা মানবিক। একজনের দুর্যোগ যদি আরেকজনের উৎসব হয়ে ওঠে, তাহলে সমাজের চোখে কি আমরা কিছুটা অন্ধ হয়ে যাচ্ছি না।
সরেজমিন দেখা গেছে, পানির নিচে এখনো ডুবে আছে ঘরবাড়ি, ফসল, মাছের ঘের। এর মধ্যে আবহাওয়া অফিস আবারও ভারী বৃষ্টিপাতের আবাসে চোখ মুখে অন্ধকার দেখছে এখনকার মানুষগুলো।
চৌগাছা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মুসাব্বির হোসাইন বলেন, বৃষ্টির পানি নামার সাথে সাথেই কৃষকরা যাতে ধান রোপণ করতে পারেন কৃষি অফিসের পক্ষ থেকে তাদের সার্বিক সহযোগিতা করা হবে।