gramerkagoj
শুক্রবার ● ১৭ অক্টোবর ২০২৫ ২ কার্তিক ১৪৩২
gramerkagoj
ভবদহের দু:খের ঢেউ যশোরের রামনগর-চাঁচড়ায়
প্রকাশ : শনিবার, ২৩ আগস্ট , ২০২৫, ১২:৫১:০০ পিএম
এস এম আরিফ:
GK_2025-08-23_68a96508c63dc.jpg

❒ রামনগরে জিয়া খালসহ বেশ কিছু খাল সংষ্কার না হওয়ায় বিল হরিণাসহ আশপাশের এলাকা হয়ে আছে জলমগ্ন। ছবি: এম.এ মানিক

# দখল ও ভরাটে বন্ধ পানি প্রবাহ
# কৃষিজমি ডুবে থাকায় দিন কাটে মাছ ধরে
# জীবন জীবীকার তাগিদে বদলে যাচ্ছে পেশা

চীনের দুঃখ যেমন হোয়াংহো তেমনই যশোরের দুঃখ ভবদহ। ভবদহের জলবদ্ধতায় যশোরের অভয়নগর, মণিরামপুর, কেশবপুরের সাথে যুক্ত হয়েছে যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়া ও রামনগর ইউনিয়নের নাম। চাঁচড়ায় মুক্তেশ্বরী নদীর একটি অংশ ভরাট ও স্থানীয়ভাবে দখল করে প্লট বিক্রির ফলে সৃিষ্ট হয়েছে জলাবদ্ধতা। একই সাথে রামনগরে জিয়া খালসহ বেশ কিছু খাল সংষ্কার না হওয়ায় বিল হরিণাসহ আশপাশের এলাকা হয়ে আছে জলমগ্ন। নদী ও খালের মাধ্যমে এই সব অঞ্চলের পানি গিয়ে পড়তো ভবদহে। এখন গতিপথ না থাকায় রূপ নিচ্ছে স্থায়ী জলাবদ্ধতায়। ফলে নষ্ট হচ্ছে কৃষি প্রতিবেশ। হাজারো বিঘা কৃষিজমি জলে ডুবে থাকায় কর্মহীন হয়ে পড়েছে এ অঞ্চলের সিংহভাগ মানুষ।

কৃষিজমি ডুবে থাকায় নেই চাষাবাদ। জীবন জীবীকার তাগিদে দিন কাটছে মাছ ধরে। ছবি : এম.এ মানিক

যশোর সদর উপজেলার রামনগর ইউনিয়নের খরিচাডাঙ্গা পূর্বপাড়া নিবাসী মিজানুর রহমান। নিজের জীবনের অর্ধশত বছর পার করলেও জমি জিরেত বলতে পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া সামান্য একটু বসতভিটে। খরিচাডাঙ্গা মৌজায় অন্যের চার বিঘা জমি বন্ধক নিয়ে চাষাবাদ করে জীবন নির্বাহ করতেন। স্ত্রী মর্জিনা বেগম, ছেলে হোসাইন আর দু’মেয়ে মরিয়ম ও আমেনাকে নিয়ে তার সংসার চলে যাচ্ছিল। মেয়ে মরিয়ম কামালপুর খরিচাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের তৃতীয় ও আমেনা প্রথম শ্রেণীর শিক্ষার্থী। বাবার সাথে ক্ষেত খামারে

কৃষিজমি ডুবে থাকায় নেই চাষাবাদ। জীবন জীবীকার তাগিদে কেউ হয়েছেন দিন মজুর, কেউবা রিকশা অথবা ইজিবাইক চালক। কারো দিন কাটছে মাছ ধরে। ছবি : এম.এ মানিক

কাজ করতো হোসাইন। জলাবদ্ধতার কারণে এখন এই পরিবারের দূর্দশার অন্ত নেই। তিন ফসলী জমি প্রায় সাত আট মাস ডুবে থাকছে জলের নীচে। মিজানুর রহমানের চোখের জল মিশছে তার জমির জলের সাথে। তারই মত দূর্দশা কবলিত রামনগর ইউনিয়নের সতিঘাটা, তোলাগোলদারপাড়া, বলাডাঙ্গা, কাজীপুর, রামনগর, কামালপুর, খরিচাডাঙ্গা, বাজুয়াডাঙ্গা, সিরাজসিংগার গ্রামবাসী। একই চিত্র চাঁচড়া ইউনিয়নের সাড়াপোল, মাহিদিয়া, চাঁচড়া, ভাঁতুড়িয়াসহ পাশ্ববর্তী গ্রামেও। বিল হরিণা এলাকায় দীর্ঘদিনের জলাবদ্ধতা কৃষি উৎপাদন ও মানুষের জীবিকাকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। অতিবর্ষণ ও কার্যকর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবে মাঠের ফসল নষ্ট হচ্ছে, আর স্থানীয়দের জীবনযাত্রা হয়ে উঠছে দুর্বিষহ।

অতিবর্ষণ ও কার্যকর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবে মাঠের ফসল নষ্ট হচ্ছে, আর স্থানীয়দের জীবনযাত্রা হয়ে উঠছে দুর্বিষহ। ছবি : এম.এ মানিক

খরিচাডাঙ্গা গ্রামের প্রবীণ ইন্তাজ আলী গাজী বলেন, মুক্তেশ্বরী নদীটি যশোরের চৌগাছা উপজেলা থেকে এসে সদর উপজেলা হয়ে বিল হরিণায় গিয়ে শেষ হয়েছে। বর্ষাকালে যশোর সদর উপজেলার বুকভরা বাওড়, যশোর ক্যান্টনমেন্ট খাল, যশোর পৌরসভা ও যশোর মেডিকেল কলেজ এলাকার পানি দক্ষিণমুখী হয়ে বিল হরিণায় গিয়ে পড়ে। আশির দশকে তৎকালীণ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের পরিকল্পনায় মুক্তেশ্বরী নদীর সঙ্গে একটি খাল খনন করা হয়। যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়া ইউনিয়নের চাঁচড়া দক্ষিণপাড়া থেকে খালটি খনন করে পূর্বদিকে রামনগরের সতিঘাটা হয়ে ঢাকুরিয়া এবং সেখান থেকে ভবদহে যুক্ত হয়। যে খালকে এলাকাবাসী ‘জিয়ার খাল’ বলে থাকেন। জিয়ার খালসহ ভরাট হওয়া অন্যান্য খাল সংস্কার করা হলে জলাবদ্ধতার অভিশাপমুক্ত হতে পারে এ অঞ্চল - জানান ইন্তাজ আলী গাজী। তার সাথে সহমত পোষণ করেন একই গ্রামের পশ্চিমপাড়ার শ্যামল চক্রবর্ত্তীসহ অন্যরাও।

যে জমির আইল থেকে ঘাস কেটে এনে গবাদীপশুর খাবার যোগাতেন অসীম বিশ্বাস সেই জমিতেই ডিঙ্গি নৌকো বেয়ে কচুরীপানা কেটে আনছেন তিনি। ছবি : এম.এ মানিক

চাঁচড়ার সত্তুর্ধ্ব আব্দুল মজিদ জানান, যশোর সদর উপজেলার চাঁচড়া ইউনিয়নের ভাতুড়িয়া বাজার থেকে পূর্বদিকের সড়কটি চাঁচড়া দক্ষিণপাড়া ধরে সামনে এগোলেই চোখে মিলবে একটি কালভার্ট। কালভার্টটির দক্ষিণে জলরাশি থাকলেও উত্তরে তার বিপরীত চিত্র। উত্তর পাশে পুরোটা ভরাট করে প্লট আকারে হচ্ছে জমি বিক্রি। নদী ভরাট করে এখানে দখল করা হয়েছে প্রায় ১০ বিঘা জমি। এ জমির উত্তর পাশে বয়ে চলেছে নদী। সেখানে বাঁধ দেওয়া হয়েছে। বাঁধের উপরে নদীর সঙ্গে সংযুক্ত রয়েছে জিয়া খাল। মূলত এ জিয়া খাল দিয়ে নদীর পানি প্রবাহিত হওয়ার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দখল করে নেওয়া হয়েছে মুক্তেশ্বরী নদী। দখল দারিত্বের কবলে পড়ে মৃতপ্রায় মুক্তেশ্বরী নদী। আর এ সব কারণেই হচ্ছে জলাবদ্ধতা।

যে জমিতে এক সময় চাষাবাদ করা হতো এখন সেই জমিতেই ধরা হচ্ছে মাছ। ছবি : এম.এ মানিক

যে জমিতে এক সময় চাষাবাদ করতেন কামালপুর গ্রামের রওশন গাজী। এখন সেই জমিতেই তার দিন কাটে মাছ ধরে। যে জমির আইল থেকে ঘাস কেটে এনে গবাদীপশুর খাবার যোগাতেন অসীম বিশ্বাস সেই জমিতেই ডিঙ্গি নৌকো বেয়ে কচুরীপানা কেটে আনছেন তিনি। ঘাসের বদলে কচুরীপানা এখন গবাদীপশুর মূল খাবারে পরিণত হয়েছে। জলাবদ্ধতার কারণে যেন এখন এ সবই যেন নির্মম নিয়তি।

রামনগর ইউনিয়নের বাসিন্দা যশোর জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সহ সভাপতি দুলাল সমাদ্দার। জলাবদ্ধতায় ডুবেছে তারও ফসলী জমি। তার কণ্ঠেও ঝরলো দুঃখ। দুলাল সমাদ্দার বলেন, ভৈরব নদ ও মুক্তেশ্বরী নদীর সীমানার সংযোগ জিয়া খাল ভরাট হওয়ায় বৃষ্টির পানিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। দ্রুত জল নিষ্কাশনের উদ্যোগ না নিলে জলবদ্ধতা স্থায়ী হয়ে যাবে।

নদী ও খালের মাধ্যমে সব অঞ্চলের পানি গিয়ে পড়তো ভবদহে। এখন গতিপথ না থাকায় রূপ নিচ্ছে স্থায়ী জলাবদ্ধতায়। ছবি : এম.এ মানিক


রামনগর ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান রামকৃষ্ণ রায় বলেন, বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি হলেই বাড়ছে জলাবদ্ধতা। বছরের বেশির ভাগ সময় পানিতে তলিয়ে থাকায় কৃষিকাজ ব্যাহত হচ্ছে। এই অঞ্চলের দূরাবস্থা নিরসনে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন তিনি।

অতিবর্ষণ ও কার্যকর পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার অভাবে মাঠের ফসল নষ্ট হচ্ছে। ছবি : এম.এ মানিক

কৃষিজমি ডুবে থাকায় নেই চাষাবাদ। জীবন জীবীকার তাগিদে কেউ হয়েছেন দিন মজুর, কেউবা রিকশা অথবা ইজিবাইক চালক। কারো দিন কাটছে মাছ ধরে। জলবদ্ধতার কারণে শিক্ষার্থীরা যেতে পারছে না শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষা কার্যক্রম। ভূক্তভোগিদের দাবি তাদের এ দূর্দশা চোখের সামনে তবু কারো দৃষ্টিতে নেই। দ্রুত খাল খনন করে জলবদ্ধতা নিরসনের দাবি জানান তারা।

আরও খবর

🔝