
অবসান হতে যাচ্ছে দীর্ঘদিনের অপেক্ষা। তারপর খুলে যাবে সম্ভাবনার আরেক দ্বার। চলতি বছরের ২৫ জুন পদ্মা সেতুর উদ্বোধন হলেও এর সুফল বঞ্চিত ছিলো নড়াইল, যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, সাতক্ষীরাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বেশ কয়েকটি জেলার মানুষ। পদ্মা সেতু দিয়ে যাতায়াত করতে এ অঞ্চলের মানুষকে কালনা ফেরি অথবা মাগুরা-ভাঙ্গা হয়ে যেতে হচ্ছিল। পদ্মার স্বপ্নযাত্রা ব্যাহত ছিলো কালনা সেতুর জন্য। তবে আশা জাগানিয়া কথা হচ্ছে এ মাসেই শেষ হচ্ছে সেতুর নির্মাণ কাজ। প্রত্যাশার রুদ্ধ সেই দ্বার উন্মোচন হতে চলেছে সেপ্টেম্বরে। নান্দনিক স্থাপত্যকলায় নির্মিত মধুমতি নদীর ওপর ছয় লেনের নেলসন লোস আর্চ পিসিগার্ডার কালনা সেতুই এখন যান চলাচলের ক্ষণগণনায়।
সরেজমিনে দেখা যায় নদীর পূর্বপাড়ের সংযোগ সড়কের কার্পেটিং এবং পশ্চিমপাড়ে পাথর-বালু ঢালাইয়ের কাজ শেষ। ৪.২৬৯ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এপ্রোচ সড়কের কালনা অংশে টি চরকালনা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে থেকে শুরু হয়ে সেতুর ওপারে কাশিয়ানীর শংকরপাশা হয়ে ভাটিয়াপাড়া গোলচত্বর পর্যন্ত কাজ শেষে চলছে লেন বিভাজনের প্যারাফেট ওয়াল স্থাপনের প্রস্তুতি। সংযোগ সড়কের ৯টি কালভার্ট এবং আটটি আন্ডারপাসের কাজ শেষ হয়েছে। সেতুর মাঝখানে বসানো হয়েছে ১৫০ মিটার দীর্ঘ স্টিলের স্প্যান। ‘নেলসন লোস আর্চ’ টাইপের ধনুকের মতো বাঁকা এ স্প্যানটি তৈরি করেছে জাপানের নিপ্পন কোম্পানি। এটাই সেতুর সবচেয়ে বড় কাজ, যা বসানো শেষ হয়েছে। এখন চলছে মূলসেতুর ওপর কার্পেটিংয়ের কাজ, যা কয়েকদিনের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে। কাশিয়ানী প্রান্তে চলছে ডিজিটাল টোলপ্লাজা নির্মাণের কর্মযজ্ঞ। চারলেনের টোলপ্লাজা আর সেতুর আলোকসজ্জার কাজও ৩০ আগস্টের মধ্যে শেষ হয়ে যাবে বলে আশাপ্রকাশ করেছেন নির্মাণকাজের দায়িত্বপ্রাপ্তরা।
২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নড়াইলে এক নির্বাচনী জনসভায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ক্ষমতায় গেলে নড়াইলের মধুমতি নদীর কালনা ঘাটে সেতু নির্মাণ করবেন। সে সময়ে না হলেও পরবর্তী মেয়াদে সরকার গঠন করে ২০১৪ সালের ১৯ জানুয়ারি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সেতুটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনার (ডিপিপি) চূড়ান্ত অনুমোদন করেন। ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সেতুটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পূর্ব পাড়ে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী আর পশ্চিমপাড়ে নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার মাঝ দিয়ে প্রবাহিত মধুমতি নদীর ওপর নির্মিত হয়েছে কালনা সেতু। সেতু সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ৬৯০ মিটার এবং প্রস্থ ২৭.১০ মিটার। এর দুপাশে পিসি গার্ডার অংশের দৈর্ঘ্য ২৭০ মিটার করে ৫৪০ মিটার। আর সেতুর মূল অংশ স্টীলের তৈরী নেলসন লোস আর্চের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার এবং উচ্চতা ৭.৬২ মিটার। দু’পাশে ৬টি করে ১২টি এবং মাঝখানে একটি মিলে স্প্যান সংখ্যা ১৩। ৯৫৯.৮৫ কোটি টাকা ব্যয়মূলে সেতুর কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের ৫ সেপ্টেম্বর। ২০২১ সালের ৪ সেপ্টেম্বর কাজ শেষ করার কথা থাকলেও করোনা অতিমারীর কারণে দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ ছিলো। পরবর্তীতে নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারিত হয় চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর। যদিও প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন ৩০ আগস্টের মধ্যেই সেতুর সবা কাজ শেষ হয়ে যাবে। তখন যশোর-ঢাকার দূরত্ব ৭০, বেনাপোল-ঢাকার দূরত্ব ১০৯ কিলোমিটার, খুলনা-ঢাকার দূরত্ব ১২১ কিলোমিটার এবং নড়াইল-ঢাকার দূরত্ব ১৮১ কিলোমিটার কমবে। একইভাবে ঢাকার সঙ্গে শিল্প ও বাণিজ্যিক শহর নওয়াপাড়া ও মোংলা বন্দর, সাতক্ষীরার দূরত্বও কমে যাবে।
কালনা সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও সওজ নড়াইলের নির্বাহী প্রকৌশলী আশরাফুজ্জামান বলেন, পদ্মা সেতু চার লেনের হলেও দেশের প্রথম ছয় লেনের সেতু হচ্ছে কালনা সেতু। সড়ক ও জনপথ বিভাগের ক্রসবর্ডার রোড নেটওয়ার্ক ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্টের আওতায় জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সী জাইকার অর্থায়নে এ সেতু হচ্ছে। জাপানের টেককেন করপোরেশন ও ওয়াইবিসি এবং বাংলাদেশের আবদুল মোনেম লিমিটেড যৌথভাবে এ সেতুর ঠিকাদার। ছয় লেনের এ সেতু হবে এশিয়ান হাইওয়ের অংশ। সেতুর চারটি মূল লেনে দ্রুতগতির ও দুটি লেনে কম গতির যানবাহন চলাচল করবে। এ সেতুর পাইলক্যাপ পানির নিচে মাটির ভেতরে। তাই নৌযান চলাচলে সমস্যা হবে না, পলি জমবে না এবং নদীর স্রোতও কম বাধাগ্রস্ত হবে। আগস্টের শেষেই সড়কটি যান চলাচলের উপযোগী হয়ে যাবে। আর সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে উদ্বোধন হবে বলে আশা করছি।
তবে, কালনা সেতুর উদ্বোধনে গণমানুষের উচ্ছ্বাসের বিপরীতে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে কালনা ঘাটের মাঝিদের। লোক আর যানবাহন পারাপারের উপর নির্ভর করে চলতো সংসার। সেতু চালু হলে তকদিরে কি আছে তা নিয়ে উৎকন্ঠায় ঘাটের মাঝিরা। তাদেরই একজন তকদির মোল্লা। টি চরকালনা গ্রামের মৃত আলিমুদ্দি মোল্লার ছেলে তকদরি মোল্লার ৫৫ বছর বয়সের ৩৭ বছর কেটেছে কালনা ঘাটে। চার মাস আগে এনজিও থেকে ৬০ হাজার টাকা লোন তুলে বড় নৌকায় ইঞ্জিণ যুক্ত করেছিলেন। সপ্তাহে এক হাজার টাকা কিস্তি পরিশোধ করতে হয়। ৪৫ কিস্তির মধ্যে মাত্র ১৫ কিস্তি শোধ হয়েছে। সেতু চালু হলে কিস্তি আর জীবন জীবিকা নিয়ে শংকায় দিন কাটছে তার মতো আরো জনা ষাটেক ঘাট মাঝির।
সেপ্টেম্বরে উদ্বোধনের পরই যানচলাচল শুরু হলে দীর্ঘদিনের ভোগান্তি কমবে, তবে পূর্ণতার ঘাটতি থাকবে বলে মনে করছেন বাসচালক সাহেব আলী। তিনি বলেন ঢাকা থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেস ওয়ে নির্মাণ করা হলেও ভাঙ্গা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত এ ধরনের সড়ক এখনো নির্মিত হয়নি। ভাঙ্গা থেকে নড়াইল-যশোর-বেনাপোল পর্যন্ত বর্তমানে সড়ক দুই লেন। এটি দ্রুত নির্মাণ হলে সুফল শতভাগ নিশ্চিত হবে।
তবে এ বিষয়েও আশার বাণী শুনিয়েছেন সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর খুলনা অঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ আসলাম আলী। তিনি জানিয়েছেন, ভাঙ্গা থেকে নড়াইল-যশোর- বেনাপোল এই অংশের এক্সপ্রেস ওয়ে সড়ক নির্মাণের বিষয়টিও প্রকল্পাধীন।
স্বপ্নের পদ্মা সেতুর পর কালনা সেতু উদ্বোধনের ক্ষণগণনায় উদ্বেল দু’পাড়ের মানুষ। তাদেরই একজন বয়োবৃদ্ধ মনসুর শেখ। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে সুখস্বপ্নের স্বাক্ষী হতে পেরে আপ্লুত তিনি। এটি শুধু সেতুর দ্বার উন্মোচনের জন্যই নয় তাদের কাছে এটি প্রধানমন্ত্রীর দেয়া প্রতিশ্রুতি পূরণেরও উপলক্ষ্য।
কালনা সেতু চালুর সাথে সাথে রাজধানীর সাথে মোংলা সমুদ্রবন্দর আর বেনাপোল স্থলবন্দর যুক্ত হয়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অর্থনৈতিক বিকাশ আর সমৃদ্ধি ত্বরান্বিত হবে। তাই শুভক্ষণের অধীর অপেক্ষায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অধিবাসীরা।