
গতকাল ছিল ২০২১ ইংরেজি বছরের প্রথম দিন New year’s day. এই বিশেষ দিনটিতে যশোর শহরের এক প্রান্তে একটি শিক্ষায়তনকে নিয়ে এক ছোট্ট ঘটনা ঘটে গেল। যার উল্লেখ আজকে এই গতিময় যুগে তুচ্ছ মনে হলেও নান্দনিক উপলব্ধির দিক থেকে হয়তো কিছুটা মূল্য বহন করে। গত সন্ধ্যায় যশোরের ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ‘সম্মিলনী ইনস্টিটিউশন’ এর কতিপয় প্রবীণ-নবীন প্রাক্তন ছাত্র স্কুলমাাঠে প্যান্ডেল বেঁধে আলোচনা, স্মৃতিচারণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যেমে স্কুলটির প্রতিষ্ঠা দিবস পালন করেছে। তারা এর নাম দিয়েছে ’সম্মিলনী ইনস্টিটিউশন দিবস’। বেশ কয়েক বছর ধরে তারা এ কাজটি করছে। তাদের লক্ষ্য বিদ্যালয়ের হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারসহ পুরাতনকে স্মরণ, শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এবং নতুনকে যুগের নিরিখে প্রস্তুতকরণ।
স্কুলের কোন জয়ন্তী বা ছাত্র-পুনর্মিলনীর মতো আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান এটি ছিল না। এর সাথে ছিল হৃদয়ের উষ্ণতা মাখা নিবিড় অনুভূতি। নিভৃত সন্ধ্যায় গ্রাম্য বধূ প্রদীপ জ¦ালতে গিয়ে যেমন সংসারের সুখ-সমৃদ্ধি কামনায় ক্ষণিক বিভোরতায় আবিষ্ট হয়, সম্ভবত উপরোক্ত আনুষ্ঠানিকতার সাথে হয়তো তারই তুলনা চলে। এভাবেই এই বয়ষ্ক কিশোরের দল প্রতিবছর ১লা জানুয়ারিতে আপন শিক্ষাঙ্গনে কয়েক ঘন্টার জন্য এক অনবদ্য নস্টালজিয়ায় হারিয়ে যায়।
‘সম্মিলনী ইনস্টিটিউশন’ যশোরের প্রথম বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ১৮৮৯ সলে এটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এর আগে ১৮৩৮ সালে সরকারি উদ্যোগে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় ‘যশোর জিলা স্কুল’। জিলা স্কুল প্রতিষ্ঠার পর দেখা যায় সেখানে ব্রিটিশ রাজের ইংরেজ কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং কিছু অভিজাত পরিবারের ছেলেরা লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে। তখন কিছু দেশীয় মানসিকতার ব্যক্তিবর্গ সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে একটি বাঙালি ভাবধারার স্কুল প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন। সে অনুযায়ী এ শহরের বেজপাড়া অঞ্চলে রবীন্দ্রনাথ সড়কের পাশে প্রথমে গোলপাতা, পরে টিনের চালা দেওয়া ঘর তুলে স্কুলের কাজ শুরু হয়। এভাবে কয়েক বছর চলার পর স্কুলটিকে স্থায়ীভাবে রূপ দিতে এগিয়ে আসেন তৎকালীন যশোর জেলার কৃতীসন্তান, জ্ঞানতাপস, দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যোৎসাহী এবং খ্যাতনামা আইনজীবী রায় বাহাদুর যদুনাথ মজুমদার। তিনি লোন অফিস পাড়ায় তাঁর কাছারিবাড়ি সংলগ্ন জমিতে স্বীয় অর্থ ব্যয়ে নতুন স্কুলভবন নির্মাণ করে পূর্বোক্ত স্কুলটিকে এখানে অধিষ্ঠিত করে নাম দেন ‘সম্মিলনী ইনস্টিটিউশন’। ১৮৮৯ সালে স্কুলটি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক স্থায়ী স্বীকৃতি লাভ করে। ১৮৮৯ সালের কোন তারিখে স্কুলটি স্থায়ী স্বীকৃতি পেয়েছিল শতাধিক বছর পর তার হদিস না পেয়ে ঐ বছরের প্রথম দিনটিকে প্রতিষ্ঠা দিবস ধরে নিয়ে সেটি আনুষ্ঠানিকভাবে পালন করা শুরু করে এই প্রাক্তন ছাত্রের দল।
উল্লেখ্য, সম্মিলনী ইনস্টিটিউশন ছাড়াও যদুনাথ মজুমদার যশোর জেলার লোহাগড়া হাইস্কুল, সুফলাকাটী হাইস্কুল, রাজঘাট হাইস্কুল, বরিশাল জেলার কদমতলা হাইস্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই সাথে বহুসংখ্যক নিম্ন প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক, মধ্য ইংরেজি ও উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনায় সহায়তা করেন। তিনি যশোর মিউনিসিপ্যালিটি ও জেলাবোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে এতদাঞ্চলের প্রভূত উন্নয়ন সাধন করেন। যদুনাথ সম্পর্কে তাঁর জীবনীকার হীরেন্দ্রনাথ মজুমদার তার ‘লোহাগড়া কাহিনী’ গ্রন্থে লেখেন- “যশোহরের টাউন হল স্থাপনের প্রথম উদ্যোক্তা যদুনাথ। ভূতপূর্ব্ব জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ এস, কে অগস্তি মহাশয়ের সাহায্যে তিনি যশোহর টাউন হলের কার্য্য সম্পূর্ণ করিতে পারিয়াছিলেন। যশোহরের ধ্বংসোন্মুখ ‘পাবলিক লাইব্রেরী’ তিনি রক্ষা করিয়াছেন এবং বর্তমানেও রক্ষা করিতেছেন। সাধারণ কার্য্যে যশোহরে যদুনাথই অগ্রণী।”
১৯৬৩ সালে আমি প্রাইমারী থেকে এসে সম্মিলনী স্কুলে ক্লাস সিক্সে কেবল ভর্তি হয়েছি। তার দুই এক মাস পর এক সন্ধ্যায় পাড়ার বড় ছেলেদের সাথে স্কুল মাঠে গিয়ে দেখি, সেখানে বিরাট প্যান্ডেল খাটিয়ে নাটক শুরু হয়েছে। ছাত্র-শিক্ষক দর্শকে চারিদিক গম গম করছে। স্কুলের উপরের ক্লাসের ছেলেরা বিলেতি সাজ-পেশাক পরে নারী-পুরুষ সেজে সম্পূর্ণ ইংরেজি ভাষা ও ভাবধারায় ইংরেজি নাটক করছে। স্কুলের ছেলেরা ইংরেজিতে নাটক করতে পারে, তা ছিল আমার কল্পনারও অতীত। বড় হয়ে অনেকদিন পর জেনেছি সেদিন সম্মিলনীর ঐ ছাত্ররা একজন গুণী শিক্ষকের নির্দেশনায় উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের ‘Macbeth’ নাটক মঞ্চস্থ করে যশোরের সুধী সমাজকে অবাক করে দিয়েছিল। শুধু একবারই নয়, এর আগে তারা পর পর দু’বছর একই কায়দায় শেক্সপিয়ারের ‘Bishop and the Candlestick’ এবং ‘Merchant of Venice ’ এর বিচারসভার দৃশ্য অভিনয় করে একই জাতীয় ঘটনা ঘটিয়েছিল। আজ ভাবি, উন্নয়নের এই যুগে দেশের কয়টি স্কুল সংস্কৃতিক্ষেত্রে এই পর্যায়ে পৌছতে সক্ষম! হয়ত একারণেই সম্মিলনীর দু’জন প্রাক্তন ছাত্রকে জাতীয় পর্যায়ে খ্যাতিমান সুরকার ও গীতিকারের মর্যাদায় আসীন হতে দেখেছি। এ প্রসঙ্গে আরেকটি কথা না বললেই নয়, তা হলো বর্তমানে যশোর শহরের প্রধান প্রধান সাংস্কৃতিক সংগঠনের যারা কর্ণধার, তাদের অধিকাংশজনই সম্মিলনীর প্রাক্তন ছাত্র।
এবার একটু খেলাধুলার কথায় আসা যাক। সম্মিলনীর ছাত্ররা ১৯৭৪ সালে আন্তঃস্কুল বাস্কেটবলে ন্যাশনাল রানার আপ হয়। ১৯৭৮ সালে আন্তঃস্কুল ফুটবলে এই স্কুলের ছাত্ররা চূড়ান্ত পর্বে খেলে। আন্তঃস্কুল ক্রিকেটে সম্মিলনীর ক্রিকেট দল ১৯৮৬-৮৭ ক্রীড়াবর্ষে ন্যাশনাল সেমিফাইনাল খেলেছিল। এরপর আন্তঃস্কুল ক্রিকেটে পরপর ৬ বছর জেলা চ্যাম্পিয়নের শিরোপা ঘরে তুলেছিল সম্মিলনী।
এবার শিক্ষায় সম্মিলনীর ছাত্রদের অতীত গৌরবের কয়েকটি নিদর্শন এখানে তুলে ধরছি। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় এ স্কুলের এক ছাত্র ১৯৪৬ সালে ঢাকা বোর্ডে ৭ম হয়। ১৯৪৭ ও ১৯৪৮ সালে যশোর জেলায় ১ম স্থান অধিকার করে সম্মিলনী স্কুলের দুই কৃতী ছাত্র। ১৯৬২ সালে আরেক ছাত্র সারা ঢাকা বোর্ডে ১৬তম স্থান অধিকার করে। আরেক গুণী ছাত্র ১৯৬৪ সালে যশোর বোর্ডে ৪র্থ হয়। শোনা যায় ১৯৪৭ এর দেশভাগের আগে সম্মিলনীর ছাত্ররা ম্যাট্রিক পরীক্ষায় কয়েকবার প্রথম বিশ জনের মধ্যে জায়গা করে নিয়েছিল।
আমি বিশ^াস করি, প্রত্যেক শিক্ষায়তনেরই কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে যা নিয়ে তার প্রাক্তন বা বর্তমান ছাত্রেরা গর্ব অনুভব করতে পারে। সে বিষয়ের প্রতি পরিপূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে সবশেষে বলতে চাই - ১৯৭১ সালে বাঙালী জাতির সর্বোচ্চ ত্যাগ ও অর্জনের মহাক্রান্তিকালে সম্মিলনী ইনস্টিটিউশনের একজন গুণী শিক্ষক ও জানামতে পাঁচজন প্রাক্তন ছাত্র শহিদ হন। মহান মুক্তিযুদ্ধে যোগদানকারী এ স্কুলের নিকট-প্রাক্তন ছাত্রের সংখ্যা সরকারি তথ্য অনুযায়ী ৩০ জনের কম নয়। এটি নিশ্চয়ই একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য গৌরবের বিষয়।
[সুপ্রাচীন এই বিদ্যাপীঠের অসংখ্য গুণী শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে বিশেষ কারো নাম উল্লেখ অনুচিত বিধায় তা থেকে বিরত থাকলাম। ক্ষমা প্রার্থনীয়।]
লেখক : রাজনীতিক ও সংস্কৃতিসেবী