Published : Saturday, 23 January, 2021 at 8:43 PM, Count : 225

পুরানো বই খাতা গোছাতে যেয়ে আমার ছেলের ক্লাস সিক্স-এ পড়ার সময় নোটবুকে লেখা একটা ছোট্ট অনুবাদ করা গল্প চোখে পড়লো। গল্পটা এমন, খুব ধনী পরিবারের একমাত্র কন্যাসন্তান। ক্লাস সেভেনে পড়ে। পড়াশোনা করার জন্য যা যা প্রয়োজন তার চেয়েও অনেক বেশি মেয়েটির জন্য ব্যবস্থা করা আছে। গৃহশিক্ষক থেকে শুরু করে যাবতীয় কিছু মেয়েটির হাতের নাগালে। তারপরও মেয়েটির রেজাল্ট ভালো হয় না। বাবা-মা খুব অস্বস্তিতে পড়েন।বকাবকিও করেন কিন্তু কোন লাভ হয় না। এরকম একদিন রাত্রে মেয়েটির বাবা মেয়ের ঘরে এসে দেখেন মেয়ে বিছানায় গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে আছে। খুব অসহায়ের মতো লাগছে তাকে। এই বয়সের একটা মেয়ের মধ্যে যে চঞ্চলতা, উদ্দীপনা থাকার কথা তার লেশ মাত্র নেই। ঘুমের মধ্যেও তার মুখে ক্লিষ্টতার ছাপ। বাবার খুব মন খারাপ হলো। একমাত্র মেয়ের করুণ মুখ বাবাকে ভাবিয়ে তুললো। তিনি মেয়ের বইখাতা উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলেন। একসময় তার চোখে পড়লো একটি নোটবুক। সেটার কয়েকটি পাতা উল্টাতেই দেখতে পেলেন একজায়গায় মেয়েটি লিখেছে-- "আমি এত চেষ্টা করি তবুও এর চেয়ে ভালো রেজাল্ট করতে পারি না। আমি যে এর বেশি আর পারি না সেটা আমার বাবা-মা, শিক্ষক, বা চারপাশের কেউই বুঝতে চায় না। আমার পৃথিবীটা যন্ত্রণাময় হয়ে উঠেছে। আমার আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে না। অথচ আমি অন্য কতকিছু পারি, সেগুলো আমাকে করতে দেয়া হয় না।" বাবা লেখা টা পড়ে চমকে উঠলেন। তিনি আবারও মেয়ের দিকে তাকালেন, বুঝতে পারলেন কি ভুল তিনি করেছেন। তিনি তখন অন্য একটা কাগজে লিখলেন, "মামণি আমি তোমার উপর অনেকখানি অবিচার করেছি। তোমার লেখাপড়ার জন্য এত আয়োজন করেছি অথচ একবারও চিন্তা করিনি তুমি কতটুকু পারবে! তোমার ধারণ ক্ষমতা কতটুকু! আমি আর তোমার উপর কিছু চাপিয়ে দেব না। তোমার সাধ্য অনুযায়ী ভালো লাগার বিষয় নিয়েই তুমি পড়বে।"
লেখাটি পড়ে আমি খুব অবাক হয়েছি, এভাবে আমরাও কি কখনো ভাবি বাচ্চাদের মনের কথা! আমার সন্তান আসলে কতটুকু ধারণ করার ক্ষমতা রাখে বা কি চায়! ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুঃসময় বর্তমানে পার করছে আমাদের শিশুরা। করোনা পরিস্থিতির এই সময় তাদের লেখাপড়া নিয়ে ইন্টারনেট, অনলাইন শব্দগুলোর সাথে টানাহেঁচড়া সত্যি লিখে বোঝানোর মতো নয়। এসময়টা বাদ দিলেও গত কয়েক দশক ধরে বাচ্চাদের নিয়ে যে ইঁদুর দৌড় শুরু হয়েছে তাতে শিশুদের আমরা সত্যিই রেসের ঘোড়া বানিয়ে দৌড় করানোর মত করাচ্ছি । বাচ্চাকে প্রথম হতে হবে, একশো তে একশো পেতে হবে, নিরানব্বই পেলেও চলবে না তাহলে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে না, সমাজে সম্মান থাকবে না। সেই চাপে একটা শিশুর শৈশব কৈশোর, স্বপ্ন কোথায় পালিয়ে যায় তার খবর আমরা কেউ রাখি না। আগে লেখাপড়া করতো শিক্ষার্থীরা তাদের মেধা- মনন অনুযায়ী, এখন শিক্ষার্থীদের চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন অভিভাবক সমাজ। অভিভাবক সমাজের চিন্তা ও উদ্বিগ্নতার তাড়নায় ছাত্রদের ইচ্ছা- অনিচ্ছা, স্বপ্ন চাপা পড়ে যায়। এর সবটাই হয়তো পরিস্থিতি অনুযায়ী অভিভাবকদের এমন আচরণে বাধ্য করে কিন্তু মাঝখান থেকে অবুঝ শিশুরা হয় রেসের জকি। বিষয়টি বহু লেখায় এসেছে এবার শুধু এটুকু বলি-- একটি শিশু যদি তার আপন মেধা অনুযায়ী সৃজনশীল ও দুশ্চিন্তামুক্ত পরিবেশে বড় হতে পারে, লেখাপড়া শিখতে পারে তখনই সে দেশের যোগ্য নাগরিক তৈরি হতে পারে। দেশের জন্য অবদান রাখতে পারে। যে ছেলেটি ছোট থেকে স্বপ্ন দেখে বড় হয়ে একজন খেলোয়াড় হবে বা একজন সাংবাদিক, অথবা সে চাকরি করবে না, নিজেই উদ্দোক্তা হয়ে অন্যের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করবে সে যখন ঘুষ দিয়ে কেরানীর চাকরি করে, মেধার মৌলিক অস্তিত্ব হারিয়ে সেও একসময় ঘুষখোরে পরিণত হয়! এভাবেই দেখা যায় সাহিত্যে তুখোড় ছেলেটি একসময় এনজিও কর্মী হয়ে টাকা পয়সার হিসেব করছে। কোথায় হারিয়ে গেছে তার সাহিত্যের যশ- প্রকাশ। আমাদের এই বিপুল জনসংখ্যার দেশে লক্ষ লক্ষ বেকারের স্বপ্ন প্রতিদিন ধুলোয় মিশে যাচ্ছে। পারিপার্শ্বিক চাপে হয়তো কত সৃজনশীল মেধা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যায়। মেধাভিত্তিক শিক্ষা এবং তার সুষ্ঠু কর্মসংস্থান কি আমাদের দেশে কোনদিনই সম্ভব হবে না!
সবশেষে করোনাকালীন দুঃসময় কাটিয়ে আমাদের শিশুরা যেন তাদের মেধা অনুযায়ী সৃজনশীল পরিবেশে বড় হতে পারে তেমনটাই আশা করি।